নাশরাত আর্শিয়ানা চৌধুরী : বাংলাদেশে সাম্প্রতিককালের ব্লগার হত্যা, সাংবাদিক নির্যাতন, একের পর এক মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও জাতিসংঘের উদ্বেগ বাড়ছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মানবাধিকার সংগঠনগুলোও উদ্বিগ্ন। এই সব ঘটনায় তারা সরকারের উপর বিভিন্ন ভাবে চাপ তৈরি করার চেষ্টা করছে। এইসব হত্যাকান্ড যাতে বন্ধ করা হয় দ্রুত সেই ব্যাপারেও চাপ তৈরি করে যাচ্ছে। মানবতাবিরোধী অপরাধের ঘটনায় যাদের শাস্তি হয়েছে তাদের বিচারের রায় ফাঁিস কার্যকর করার ব্যাপারেও তারা উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। এই অবস্থায় তারা তাদের মতো করে অবস্থানও ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করছে।
সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিশা দেশাই বাংলাদেশ সফর করেন। এখন আরও কিছু প্রতিনিধিরা বাংলাদেশ সফরে আসছেন। বাংলাদেশে সরকার, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যতক্ষন না সব ধরনের হত্যাকান্ড বন্ধ করতে পারছে ততক্ষন পর্যন্ত এই ব্যাপারে তারা নিশ্চিত হতে পারছে না। তাদের দেশের নাগরিকরা যারা বাংলাদেশে অবস্থান করছে তাদের নিয়েও উদ্বিগ্ন। তারা বার বার তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য বলছে। তবে হত্যাকান্ডের ঘটনা বন্ধ না হওয়ার কারণে সমস্যার সমাধান হচ্ছে না। তাদের উদ্বেগ থাকাবস্থায় শুক্রবার রাতে বান্দরবানে বৌদ্ধ ভিক্ষু হত্যার ঘটনা ঘটেছে।
এদিকে সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে একের পর এক ব্লগার হত্যা, সাংবাদিক নির্যাতন, মানবাধিকার লংঘন এবং যুদ্ধাপরাধের বিচারের নামে মৃত্যুদন্ড কার্যকর ইস্যুতে আবারো উদ্বেগ প্রকাশ করেছে জাতিসংঘ। জাতিসংঘের সদর দপ্তরের নিয়মিত ব্রিফিংয়ে বাংলাদেশ ইস্যুতে বিশ্বসংস্থার উদ্বেগসহ নানা দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেন মহাসচিব বান কি মুনের মুখপাত্র স্টিফেন ডোজারিক। এসময়ে বাংলাদেশী সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নেরও জবাব দেন তিনি। এছাড়াও বাংলাদেশ থেকে তুরস্কের রাষ্ট্রদূত প্রত্যাহারের বিষয়টি দু’দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় বলেও দাবি করেন স্টিফেন ডোজারিক।
গত ১৩ মে শুক্রবার (নিউইয়র্ক সময়) দুপুরে জাতিসংঘের নিয়মিত ব্রিফিংয়ে অংশ নেন মহাসচিব বান কি মুনের মুখপাত্র স্টিফেন ডোজারিক। এসময়ে বিশ্বের সমসাময়িক ঘটনার সাথে উঠে আসে বাংলাদেশ প্রসঙ্গ। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে ব্লগার জুলহাজ মান্নান হত্যা, সাংবাদিক শফিক রেহমান, শওকত মাহমুদসহ গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, মৃত্যুদন্ড, জাতিসংঘ শান্তি রক্ষী মিশনের বাংলাদেশের সৈনিক এবং মানবাধিকার বিষয়ে জাতিসংঘের অবস্থান জানতে চান বাংলাদেশ এবং বিদেশী সাংবাদিকরা।
বাংলাদেশ ইস্যুতে সম্প্রতি নিউইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত একটি সম্পাদকীয়ের উদ্ধৃতি দিয়ে বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও বিচারহীনতা প্রসঙ্গে সাংবাদিক মুশফিক ফজল আরসারি জাতিসংঘের অবস্থান জানতে চাইলে ডোজারিক বলেন, বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতা, মুক্তমনা তথা ব্লগার হত্যাকান্ড, বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ডসহ গণমাধ্যমের জেষ্ঠ্য সাংবাদিকদের নির্যাতনকে সমর্থন করছি না আমরা। এ বিষয়ে জাতিসংঘ মহাসচিবের উদ্বেগের কথা জানিয়ে পরিস্থিতির দ্রুত উন্নতি হবে বলে আশা করেন। এছাড়াও মৃত্যুদ-ের নামে বিচারিক হত্যাকান্ড বন্ধে আন্তর্জাতিক নীতি মেনে চলবে বাংলাদেশ এমনটিও জানান তিনি।
এসময়ে জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্র হিসেবে শান্তি মিশনে বাংলাদেশের অবস্থান থাকাবস্থায়, পার্বত্য অঞ্চলে সেনাবাহিনী কর্তৃক নারী ও শিশু নির্যাতনসহ মানবাধিকার লংঘনের অভিযোগ তোলেন আমেরিকান এক সাংবাদিক। তার প্রশ্নের জবাবে ডোজারিক বলেন, বিষয়টি তাদের জানা নেই, তবে খতিয়ে দেখা হবে।
এছাড়াও জামায়াতের আমীর মতিউর রহমান নিজামীর ফাঁসির দন্ড কার্যকর ইস্যুতে তুরস্কের রাষ্ট্রদূত প্রত্যাহারকে দুই দেশের অভ্যন্তরীণ ও দ
্বিপক্ষীয় সম্পর্ক বলে মত দেন তিনি। একই সাথে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় গণমাধ্যমের অবাধ স্বাধীনতার বিষয়টিকে গুরুত্ব দিতে সরকার কার্যকর পদক্ষেপ নেবে বলেও আশা জাতিসংঘের।
এদিকে এর আগে জামায়াতের আমির মাওলানা মতিউর রহমান নিজীমীর ফাঁসি কার্যকরের ঘটনায় জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তারা মৃত্যুদন্ড কার্যকরের বিপক্ষে সব সময় কথা বলে আসছেন। তিনি এর আগে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রধানমন্ত্রী ফোনে করেও সেই উদ্বেগের কথা জানিয়েছেন। নিজামীর ফাঁিস কার্যকরের পরেও ফের উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তবে বাংলাদেশ জাতিসংঘের এই উদ্বেগকে কোন গুরুত্ব দিচ্ছে না। মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার সম্পন্ন করার জন্য সরকাররের সামনে আর কোন সুযোগ নেই মনে করছে সরকার।
এদিকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়িতে বৌদ্ধ ভিক্ষু মং শৈ উ হত্যাকান্ড একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা। এই ঘটনার জন্য তিনি ধর্মগুরুর স্বজনদের দায়ী করেছেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে সাংবদিকরা বান্দরবানের বৌদ্ধ ভিক্ষু হত্যার ঘটনা সম্পর্কে জানতে চান। এই সময়ে তিনি বলেন, এটা একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা। এর সঙ্গে তার (ভিক্ষু) আত্মীয় স্বজন জড়িত রয়েছে বলে মনে করছি।
শুক্রবার রাতে মন্দিরে গলা কেটে হত্যা করা হয় চাকপাড়া বৌদ্ধ বিহারের অধ্যক্ষ মং শৈ উ (৭০)কে। তাকে খাবার দিতে গেলে স্থানীয়রা তার মরদেহ দেখতে পায়। তার দেহ রক্তাক্ত অবস্থায় ছিল। তার দেহ থেকে গলা প্রায় বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়েছে। তার মৃত্যুর ঘটনায় ওই এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে।
উত্তরাঞ্চলে সম্প্রতি খ্রিস্টান যাজক ও হিন্দু পুরোহিতের উপর যেভাবে হামলা হয়েছে, এই হত্যাকান্ডের ধরনও তেমনি। তবে পার্বত্যাঞ্চলে এই ধরনের হত্যাকান্ড এটাই প্রথম। যাজক ও পুরোহিতের উপর হামলায় জঙ্গিদের জড়িত থাকার প্রমাণ মিললেও ভিক্ষু হত্যাকান্ডের কারা জড়িত, তাৎক্ষণিকভাবে সে বিষয়ে কিছু বলতে পারেনি পুলিশ। পুলিশ ঘটনার তদন্ত করছে।
অধ্যাপক রেজাউল করিমকে গত মাসে রাজশাহীতে তার বাড়ির কাছে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। এতে জঙ্গিরা জড়িত বলে পুলিশের ধারণা। শিক্ষক হত্যাকান্ডে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষোভের মধ্যে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, আমরা প্রত্যেক হত্যাকান্ড তদন্তের মাধ্যমে বিচার করতে পেরেছি। একমাত্র সাগর-রুনি হত্যাকান্ডে এখনও কোনো বিচার হয়নি। ২০১২ সালে সাংবাদিক দম্পতি সাগর সরওয়ার ও মেহেরুন রুনিকে তার ঘরে হত্যা করা হয়। এই হত্যাকান্ডের তদন্ত এখনও শেষ হয়নি বলে বিচারও শুরু হয়নি।