এম. ইউছুপ রেজা, চট্টগ্রাম : চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলার গোমদ-ী পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ে চলছে রমরমা কোচিং বাণিজ্য। সরকারের নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করেই চলতি বছরের দ্বিতীয় মাস থেকেই ৬ষ্ট-১০ম শ্রেণীর প্রায় তেরশ ছাত্র-ছাত্রীর সবার জন্য কোচিং করা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
এতে কোচিং না করলেও প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে ফি পরিশোধ করতে হয়। বিদ্যালয় কতৃপক্ষ কোচিং এর নামে অসহায় অভিভাবকদের কাছে থেকে প্রতি মাসে হাতিয়ে নিচ্ছে লাখ লাখ টাকা।
শিক্ষার্থী ও অভিভাবক সূত্রে জানা গেছে, উপজেলার সদরে অবস্থিত গোমদ-ী পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়টি। সদরে অবস্থিত হওয়ায় উপজেলার বিভিন্ন স্থান থেকে ছাত্র-ছাত্রীরা ছুটে আসেন এ বিদ্যালয়ে । অভিভাবকরা তাদের ছেলে মেয়েদের এ বিদ্যালয়ে পড়াতে বেশ আগ্রহী। শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের এ সরলতাকে পুঁজি করে বিদ্যালয় কতৃপক্ষ কোচিং এর নামে তাদের কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের কোচিং নীতিমালায় বলা হয়েছে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নির্ধারিত সময়ের পূর্বে বা পরে শুধু অভিভাবকদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিষ্ঠান প্রধান অতিরিক্ত ক্লাসের ব্যবস্থা করতে পারবেন। এ ক্ষেত্রে প্রতি বিষয়ে মেট্রোপলিটন শহরে মাসিক ৩০০ টাকা, জেলা শহরে ২০০ টাকা এবং উপজেলা বা স্থানীয় পর্যায়ে ১৫০ টাকা করে রসিদের মাধ্যমে নেওয়া যাবে। দরিদ্র শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠান প্রধান স্ববিবেচনায় এই হার কমাতে বা মওকুফ করতে পারবেন। একটি বিষয়ে মাসে সর্বনিম্ন ১২টি ক্লাস হতে হবে এবং এ ক্ষেত্রে প্রতিটি ক্লাসে সর্বোচ্চ ৪০ জন শিক্ষার্থী অংশ নিতে পারবে। এই টাকা প্রতিষ্ঠানপ্রধানের নিয়ন্ত্রণে একটি আলাদা তহবিলে জমা থাকবে। প্রতিষ্ঠানের পানি, বিদ্যুৎ, গ্যাস ও সহায়ক কর্মচারীর ব্যয় বাবদ ১০ শতাংশ টাকা কেটে রেখে বাকি টাকা অতিরিক্ত ক্লাসে নিয়োজিত শিক্ষকদের মধ্যে বণ্টন করা হবে। কোনোক্রমেই এ টাকা অন্য খাতে ব্যয় করা যাবে না।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রণীত কোচিং বাণিজ্য বন্ধ নীতিমালা অনুসরণের নির্দেশ দিয়েছে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতর (মাউশি)। সম্প্রতি সংস্থাটির সহকারি পরিচালক সাখায়েত হোসেন বিশ্বাস স্বাক্ষরিত এই আদেশে একইসঙ্গে কোনো শিক্ষক এই নীতিমালা লংঘন করে কোচিং বাণিজ্য করেন কিনা তা মনিটরিংয়ের নির্দেশও দেয়া হয়েছে। থানা ও জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা এবং আঞ্চলিক পরিচালকরা এই মনিটরিং করবেন।
শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের সাথে কথা বলে আরো জানা যায়, বিদ্যালয়ে কোচিং করা বাধ্যতামূলক । তবে কোচিং না করলেও ফি পরিশোধ করতে হয়। এটি বাধ্যতামূলক। তাদের পরিবারে উপার্জনাক্ষম ব্যক্তি একজন এবং যে পরিবারে দু তিন জন ছেলে-মেয়ে লে খাপড়া করে তাদের এ কোচিং বাণিজ্যের কবলে পড়ে নিঃস্ব হওয়ার কথাও বলেন। শিক্ষা নাগরিক অধিকার হলেও গোমদন্ডী পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় কতৃপক্ষ এটিকে পণ্য হিসেবে গণ্য করেছেন।
কোচিং বাণিজ্য নিয়ে কোন শিক্ষার্থী ও অভিভাবক বাদ-প্রতিবাদ করলে ঐ শিক্ষার্থীকে বিদ্যালয় থেকে বহিস্কার করার হুমকি দেয় বিদ্যালয় কতৃপক্ষ।
সরকার শিক্ষাকে মানুষের দোরগোড়ায় পৌছেঁ দেয়ার লক্ষ্যে নতুন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন, শিক্ষক নিয়োগ ও শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধি করলেও এ বিদ্যালয়ে তার ঠিক বিপরিত চিত্র দেখে হতবাক এতদাঞ্চলের শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক শিক্ষার্থী অভিযোগ করে বলেন, ‘শুধু শুধু কিছু লোক দেখানো কয়েকটি ক্লাস নিয়ে আমাদের কাছ থেকে প্রধান শিক্ষক টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন এবং টাকা পরিশোধ বিলম্ব হলে আমাদের গালমন্দ করেন। এছাড়া যারা গত কয়েকমাসের কোচিং ফি পরিশোধ করতে পারেনি তাদের সদ্য অনুষ্ঠেয় মডেল টেষ্ট প
রিক্ষার হল থেকে বের করে দেওয়া হয়। ’
রেজাউল করিম বাবুল নামের এক অভিভাবক বলেন, ‘দেশের কোথাও এমন কোচিং বাণিজ্য চলে না। সরকারি স্কুল হয়েও বছরের শুরু থেকে সব শ্রেণীর ছাত্র-ছাত্রীদের কোচিং করতে বাধ্য করেছেন শিক্ষকরা। মাত্র ১-২ ঘণ্টা কোচিংয়ের নামে শিক্ষকরা টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন লাখ লাখ টাকা। সব মিলিয়ে এক সময়ের ঐতিহ্যবাহি বিদ্যালয়টি এখন ঐতিহ্য হারাতে বসেছে।’
কোচিং করানোর কথা স্বীকার করে বিদ্যালের সিনিয়র শিক্ষক মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘সরকারের নিয়ম মেনেই প্রধান শিক্ষকের নির্দেশে কোচিং করানো হচ্ছে।’
বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মইনুল আবেদিন নাজিম বলেন, ‘সরকারি নিয়ম অনুযায়ি বিশেষ ক্লাস ফি প্রতিজন শিক্ষার্থীর একশত পঞ্চাশ টাকা হলেও আমরা সব বিষয় পড়ায়ে তিনশত টাকা নিই। তবে এ টাকায় কোন রশিদ দেয়া না হলেও রেজিষ্টার বইয়ে লিপিবদ্ধ করা হয়।
উপজেলা শিক্ষা অফিস থেকে দুইশ গজ ব্যবধানে গোমদণ্ডী পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় অবস্থিত হলেও দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা কোচিং বাণিজ্যের ব্যাপারে কিছুই জানেন না বলে জানিয়েছেন উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার মো. ইউনুচ। তবে বিষয়টি খতিয়ে দেখবেন বলে জানান তিনি।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কাজী মাহবুবুল আলম বলেন, ‘স্কুলের কোচিং বানিজ্যের বিষয়ে আমি ব্যক্তিগত ভাবে অবগত হয়ে বিষয়টি খতিয়ে দেখার জন্য উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকতা মো. ইউনুচকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।’