নাশরাত আর্শিয়ানা চৌধুরী: বাংলাদেশে একের পর এক ধর্মীয় নেতাদের হত্যা করা হচ্ছে। তারা কেউ মসজিদের ইমাম। কেউ মন্দিরের পুরহিত, কেউ গির্জার পাদ্রী আবার কেউ বৌদ্ধ ভিক্ষু। একের পর এক হত্যাকা-ের ঘটনায় আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। এই কারণে দেশে বিদেশে অনেকেই মনে করছেন বাংলাদেশে এখন আর ধর্ম যাজকরা নিরাপদ নন। তাদের বেশ কয়েকজনকে হত্যা করার পর নানা দিক থেকেই সরকার সমালোচনার মুখে পড়ছে। তবে তারা কোন ভাবেই এই ধরনের টার্গেট কিলিংয়ের ঘটনাগুলো বন্ধ করতে পারছে না।
সরকার এই সব হত্যাকা-ের ঘটনাকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে মনে করছে। সর্বশেষ বান্দরবানের ঘটনাটি তার স্বজরাই ঘটিয়েছেন বলেও মন্তব্য করেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। তবে এই ধরনের হত্যাকা-ের ঘটনা সরকার বন্ধ করতে না পারলে দেশে এই ব্যাপারে বড় ধরনের সমস্যা ও সংকট তৈরি হতে পারে বলে মনে করছেন বিশিষ্ট জনরা। সেই সঙ্গে এই ধরনের হত্যাকা- বন্ধ করার জন্য ও অপরাধীদের গ্রেফতার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করার জন্য আন্তর্জাতিক মহল থেকেও চাপ রয়েছে।
এই অবস্থায় এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের জ্যাকসন হাইটসে অনুষ্ঠিত হলো প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ সমাবেশ। বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার বাইশারি এলাকার চাকপাড়ায় পঁচাত্তর বছর বয়সী বৌদ্ধ ভিক্ষু মং সু উচাককে হত্যার প্রতিবাদে গত ১৪ মে বিকেলে নিউইয়র্কের বাংলাদেশী অধ্যুষিত এলাকা জ্যাকসন হাইটসের ডাইভার সিটি প্লাজায় ‘বুদ্ধিস্ট কমিউনিটি অব বাংলাদেশ’ প্রতিবাদ বিক্ষোভ সমাবেশ করে। সমাবেশ থেকে সকল ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে একই কায়দায় ধর্মীয় প্রধানদের হত্যার প্রতিবাদ করে বলা হয় মসজিদে ইমামকে, গীর্জায় পাদ্রীকে হত্যার পর উগ্রজঙ্গীবাদী গোষ্ঠী বান্দরবানে ধ্যানরত অশতিপর ভিক্ষু মং সু উচাককে হত্যা করেছে। এসব হত্যাকা- একই সূত্রে গাঁথা। সমাবেশ থেকে প্রকৃত অপরাধীকে গ্রেফতার করে দেশের বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মধ্যে আস্থা ফিরিয়ে আনার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো হয়।
স্বীকৃতি বড়–য়ার পরিচালনায় সমাবেশে নিউইয়র্কে বাংলাদেশী বৌদ্ধদের প্রধান সত্যানন্দ থেরো ভিক্ষু বলেন, বৌদ্ধরা শান্তিপ্রিয় এবং শান্তির ধর্ম বৌদ্ধধর্ম- মং সু উচাককে হত্যার মধ্যে দিয়ে দেশে বৌদ্ধদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করা হয়েছে। সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী একে পারিবারিক হত্যাকা- বলে প্রচার করে হত্যাকারীদের দায়মুক্তি দিচ্ছেন।
নিউইয়র্ক থেকে এনা জানায়, বাংলাদেশে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদ যুক্তরাষ্ট্র শাখার প্রধান উপদেষ্টা শিতাংশু গুহ বলেন, মৌলবাদের উত্থানের কারণে বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের প্রতিদিনই খুন করা হচ্ছে। তারই ধারাবাহিকতায় আজ ৭৫ বছর বয়সী বৌদ্ধ ভিক্ষুকে খুন করা হল। স্বজনরা জড়িত আছে বলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যে ভিত্তিহীন বক্তব্য রেখেছেন, তার তীব্র সমালোচনা করেন তিনি।
অজিত বড়ুয়া তার বক্তব্যে বলেন, বৌদ্ধ ভিক্ষুরা শান্তিপ্রিয়, তারা শান্তির বাণী প্রচার করে, তাদের সাতে কারো বিরোধ নেই। কিন্তু যে নরপশুরা ধ্যানরত অবস্থায় এই বৌদ্ধ ভিক্ষুকে হত্যা করেছে, তাদের বিচার এই প্রবাস থেকে আমরা দাবী করছি।
প্রবীর বড়ুয়া বলেন, বাংলাদেশে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের উপর একের পর এক আক্রমণ হচ্ছে, কিন্তু একটি ঘটনারও বিচার হচ্ছে না বলেই আজ আরও একজন বৌদ্ধ ভিক্ষুকে প্রাণ দিতে হল। তিনি হত্যাকারীদের দ্রুত গ্রেপ্তারের দাবী জানান।
সুবীর বড়ুয়া তার প্রতিবাদে বলেন, বাংলাদেশে আজ বিচারহীনতার সংস্কৃতি বিরাজ করছে। নারী, শিশু, সংখ্যালঘুরা প্রতিদিনি খুন হচ্ছে, ধর্ষিত হচ্ছে। তিনি বলেন একজন ৭৫ বছর বয়সী বৌদ্ধ ভিক্ষুকে যারা হত্যা করতে পারে, তাদের কোন ধর্ম নেই, তাদের কোন ধর্ম থাকতে পারেনা। তিনি এই হত্যাকা-ের তীব্র ন
িন্দা জানান।
বক্তারা আরো বলেন মসজিদের ইমাম, মন্দিরের পুরোহিত বা বৌদ্ধ ভিক্ষু বাংলাদেশে কেউ আজ নিরাপদ নন। সরকার যদি এই মৌলাবাদীদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থ্যা না নেন, তাহলে বাংলাদেশে এরকম হত্যাকা- আরো ঘটবে। বাংলাদেশেকে বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।
অন্যানের মধ্যে সমাবেশে উপস্থিত ছিলেন উর্মি বড়–য়া, অজিত বড়–য়া, বিশ্বন্তর বড়–য়া, বিনয়ন চাকমা, লারি মং, সৃষ্টি বড়–য়া, চিচিম বড়ুয়া, রূপক বড়ুয়া, মোহাম্মদ আলী বাবুল, বিনয় চাকমা, দুলাল সিং, শিশির বড়ুয়া, পাথই মং, ইষান বড়–য়া, মিনতি বড়–য়া,লা মে রাখাইন, মেরিনা বড়–য়া, মা সু উই মারমা, আ মারি রাখাইন, টিটু বড়–য়া শিশুনিয়ন চাকমা।
এদিকে বান্দরবানে ভিক্ষু হত্যা কোন বিচ্ছিন্ন কোন ঘটনা নয় বলে মনে করেন বাংলাদেশে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট রানা দাশ গুপ্ত। তিনি বলেন, ১৯৭৫ সালের পর একদিকে সংবিধানকে সাম্প্রদায়িকরণ করা হয়েছে, অন্যদিকে রাষ্ট্রধর্মকে সংবিধানে সংযোজিত করা হয়েছে। আজকে যে সাম্প্রদায়িকতা তৃণমূল পর্যন্ত ছড়িয়ে গেছে এর পেছনে মূল কারণ হচ্ছে একদিকে সংবিধান অন্যদিকে রাষ্ট্র রাজনীতিতে ধর্মকে ব্যবহার, তাকে আশ্রয়-প্রশ্রয় এবং উৎসাহ দানের যে অব্যাহত ধারা। আমরা মনে করি তার মধ্য দিয়েই উগ্রবাদ এবং জঙ্গিবাদ পরিপুষ্ট হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ গড়ার জন্য দেশের মানুষ এক ধরণের আন্দোলনে আছে। ঠিক তাকে নস্যাৎ করে দিয়ে বাংলাদেশকে মধ্যপ্রাচ্যের সিরিয়া, আফগানিস্তানের মতো একটি মৌলবাদী রাষ্ট্রে পরিণত করার জন্য একটি রাজনৈতিক প্রক্রিয়া একইভাবে অব্যাহত আছে। আর এই রাজনৈতিক প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকার মধ্য দিয়েই আমরা লক্ষ্য করছি যে, ইসলাম ধর্মের মধ্যেই ভিন্ন মতালম্বিদের হত্যা করা হচ্ছে। আজকে হিন্দু পুরোহিতদের হত্যা করা হচ্ছে, বৌদ্ধ ধর্ম যাজকদের হত্যা করা হচ্ছে, খ্রিস্টান ধর্ম যাজকদের হত্যা করা হচ্ছে। শুধু তাই না মুক্তবুদ্ধির, মুক্ত চিন্তার পক্ষে যারা তাদের উপরও কিন্তু একই ধারায় আজকে চাপাতির আঘাত করা হচ্ছে। যারা মুক্ত চিন্তার চর্চা করছেন রাষ্ট্রিয়ভাবে তাদের বিরুদ্ধে বিষদগার করা হচ্ছে। আমরা মনে করি এর মধ্য দিয়েই ঐ ঘাতক শক্তি প্রকারান্তরে উৎসাহিত হচ্ছে। যারা হত্যা করেছে সেই ঘাতকদের আজ পর্যন্ত গ্রেপ্তার করে শাস্তি দেওয়া হয়েছে বলে আমাদের কাছে কোন খবর নেই। মনে হচ্ছে একটি দায় মুক্তির সংস্কৃতি অব্যাহত রয়েছে।
আইএস প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বাইরে থেকে বলা হয় বাংলাদেশে আইএস আছে। আবার সরকার থেকে বলা হয় নেই। আছে কি নেই আমি মনে করি সে বিতর্ক অর্থহীন। কিন্তু আইএসের উগ্র ভাবাদর্শ নিয়ে বাংলাদেশে একটি চক্র যুগপৎ ভাবেই আমাদের রাজনীতির মাঠে ক্রিয়াশীল আছে। এরা কোন সময় কোন ভূমিকা পালন করছে সেটিই দেখার বিষয়। জঙ্গিবাদকে প্রশ্রয় দেওয়া হবে না বলে আমাদের প্রশাসনের যে বক্তব্য তা কিন্তু আজকে জনগণকে আশান্বিত করতে পারছে না। আমরা সবাই চাই এই ঘাতক চক্রকে উদঘাটিত করে বিচারের আওতায় আনা হোক।