সাইদুর রহমান : বাংলাদেশের নির্বাচনের ইতিহাসে বিনাভোটে জয়ের সব রেকর্ড ভঙ্গ হয়েছে এবারের ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনে। চেয়ারম্যান পদে ছয় ধাপে ১৯৭ জন ভোট ছাড়াই নির্বাচিত হয়েছেন। যা ১৯৮৮ সালের একদিনে অনুষ্ঠিত ইউপি নির্বাচনকে ছাড়িয়ে গেছে। ওই সময় ১০০ জন বিনা ভোটে চেয়ারম্যান হয়েছিলেন। এখন পর্যন্ত চার হাজার ১২৬টি ইউপির মধ্যে বিএনপি ৫৫৪টিতে কোনো প্রার্থী দিতে পারেনি।
নির্বাচন কমিশন (ইসি) থেকে প্রাপ্ত তথ্যে দেখা গেছে, ইউপি নির্বাচনের প্রথম চার ধাপে অনুষ্ঠিত দুই হাজার ৬৬৯ ইউপির মধ্যে ১৫০টিতে প্রার্থীরা বিনা ভোটে নির্বাচিত হয়েছেন। তারা সবাই আওয়ামী লীগের প্রার্থী। প্রথম ধাপে ৭১২টি ইউপিতে ৫৪ জন, দ্বিতীয় ধাপে ৬৩৯টি ইউপিতে ৩৪ জন, তৃতীয় ধাপে ৬১৫টিতে ২৯ জন ও চতুর্থ ধাপে ৭০৩টি ইউপিতে ৩৩ জন বিনা ভোটে নির্বাচিত হয়েছেন। এছাড়া পঞ্চম ধাপের ৭২৯টি ইউপির মধ্যে ৪২ জন বিনা ভোটে নির্বাচিত হয়েছেন। ষষ্ঠ ধাপে এখন পর্যন্ত পাঁচজনের বিনা ভোটে জয়ের তথ্য এসেছে ইসিতে। যদিও এই ধাপে আগামী ১৯ মে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষদিনে এ সংখ্যা আরো বাড়তে পারে বলে মনে করছেন ইসির সংশ্লিষ্টরা। তারা জানিয়েছেন, দলীয় প্রতীকে ইউপি ভোট হওয়ার কারণেই বিনাভোটে জয়ীর সংখ্যা বেড়েছে।
অতীতের ইউপি নির্বাচন পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার ক্ষেত্রে আগের সব রেকর্ডই এবার ভেঙে গেছে। অতীতে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিতের রেকর্ড ছিল ১৯৮৮ সালের নির্বাচনে। এরশাদ সরকারের সময় অনুষ্ঠিত ওই ইউপি নির্বাচনে ১০০ জন চেয়ারম্যান বিনা ভোটে জয়ী হন। ওই সময় ওই নির্বাচনকে অস্বাভাবিক বলে উল্লেখ করা হয়েছিল। এরপর কোনো স্থানীয় নির্বাচন, বিশেষ করে ইউপি নির্বাচনে বিনা ভোটে জয়ের সংখ্যাটা তেমন উল্লেখযোগ্য ছিল না। ১৯৯২ সালের ইউপি নির্বাচনে মাত্র চারজন চেয়ারম্যান বিনাভোটে জয়ী হয়েছিলেন। ১৯৯৭ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের সময় বিনাভোটে নির্বাচিত হয়েছেন ৩৭ জন। ২০০৩ সালের বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময় বিনাভোটে চেয়ারম্যান হয়েছেন ৩৪ জন। ২০১১ সালের নির্বাচনে এই সংখ্যা দুই অঙ্কে পৌঁছেনি বলে ওই সময় দায়িত্বে থাকা ইসি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। এছাড়াও এর আগে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ১৫৪ জন ভোট ছাড়াই নির্বাচিত হন। গত বছরের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত ২৩৪ পৌরসভার নির্বাচনে ১৪০ জন প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। এদের মধ্যে মেয়র ৬ জন, সাধারণ কাউন্সিলর ৯৪ জন ও সংরক্ষিত কাউন্সিলর ৪০ জন ছিলেন। ২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত চতুর্থ উপজেলা পরিষদের নির্বাচনেও বেশ কয়েকজন ভোট ছাড়াই নির্বাচিত হন।
এদিকে বিএনপির প্রার্থীহীনতার তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ছয় ধাপে দলটির ৫৫৪টি ইউপিতে কোনো প্রার্থী নেই। এর মধ্যে প্রথম ধাপে ১১৯টি, দ্বিতীয় ধাপে ৭৯টি, তৃতীয় ?ধাপে ৮১টি ও চতুর্থ ধাপে ১০৬টি ইউপিতে দলটির কোনো প্রার্থী ছিল না। ২৮ মে অনুষ্ঠিতব্য পঞ্চম ধাপের ৭২৯টি ইউপির মধ্যে ১০০ ইউপিতে তাদের কোনো প্রার্থী নেই। ষষ্ঠ ধাপে আগামী ৪ জুন ৭২৮টি ইউপিতে ভোট হবে। ইতোমধ্যে ৬৯ ইউপিতে বিএনপির কোনো প্রার্থী মনোনয়ন দাখিল করেননি। এ ধাপে আওয়ামী লীগ ৭২২টি ও বিএনপি ৬৫৯টি ইউপিতে মনোনয়ন জমা দিয়েছে। ছয় ধাপে এখন পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগও ১০টি ইউপিতে তাদের কোনো প্রার্থী দিতে পারেনি। এর মধ্যে প্রথম ধাপে একটি, পঞ্চম ধাপে ৩টি এবং ষষ্ঠ ধাপে ৬টি ইউপিতে দলটির প্রার্থী নেই।
বিএনপির প্রার্থী দিতে না পারার বিষয়ে স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান জানিয়েছেন, বিভিন্ন স্থানে সরকার দলীয় প্রার্থী ও প্রশাসনের ভয়ভীতির কারণে তাদের প্রার্থীরা মনোনয়নপত্র জমা দিতে পারেননি। কোনো
কোনো স্থানে মনোনয়নপত্র জমা দিলেও জোরপূর্বক তা প্রত্যাহারে বাধ্য করা হয়েছে। অবশ্য এই অভিযোগের বিপরীতে কোথাও কোথাও প্রার্থী না পাওয়া বা ব্যক্তিগত কারণে দলীয় মনোনয়ন নিয়েও শেষ পর্যন্ত নির্বাচন থেকে সরে যাওয়ার অভিযোগ রয়েছে। অন্যদিকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, বিএনপি প্রার্থী দিতে না পেরে নির্বাচনকে নানাভাবে বিতর্কিত করার চেষ্টা করছে।
এ বিষয়ে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি থেকে বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার যে সুযোগ তৈরি হয়েছে, ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে তার প্রভাব দেখা যাচ্ছে। এটা গণতন্ত্রের জন্য নেতিবাচক।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশনার মোঃ শাহ নেওয়াজ ইত্তেফাককে বলেন, আইন অনুসরণ করেই ইউপি নির্বাচনের আয়োজন করা হচ্ছে। প্রার্থীদের সুবিধার জন্য এবারই প্রথম রিটার্নিং অফিসার ও ডিসি অফিসে মনোনয়ন জমা নেয়া হচ্ছে। প্রার্থীরা যৌক্তিক অভিযোগ করলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাও নেয়া হচ্ছে।
উল্লেখ্য, ৪ হাজার ২৭৫টি ইউপির নির্বাচন এবার ছয়ধাপে শেষ করার সিদ্ধান্ত নেয় ইসি। গত ১১ ফেব্র“য়ারি তফসিল ঘোষণার মধ্যদিয়ে এ নির্বাচন শুরু হয়।