মোহিত রাও: স্বদেশ থেকে কয়েক হাজার মাইল দূরে থাকলেও বাংলাদেশের ব্লগারদের কর্মকা- রুদ্ধ হওয়ার পথে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে তারা রাজপথ থেকে অনলাইন মুখর করে রেখেছিল। তবে আজ তারা আরো বেশি আতঙ্কের মধ্যে আছে। লক্ষ্যণীয় হলো- ৭১’এর হত্যাকা-ে জামায়াতে ইসলামের আমীর মতিউর রহমান নিজামীর মৃত্যুদ- হলেও ব্লগারদের স্বাধীনতা সংকুচিত হয়ে পড়ছে।
কেন আমাদের দেশ ছেড়ে বিদেশ বিঁভূইয়ে ভয় আর আতঙ্কের মধ্যে কাটাতে হচ্ছে? এমনকি যারা যুদ্ধাপরাধের মতো কুকর্ম করেছে বা আমাদের উপর হামলাকারীরা বাংলাদেশে ক্ষমতা ও দাপটের সাথেই আছে। টাকা পয়সারও অভাব নেই তাদের। এ প্রশ্ন মাহমুদুল হক মুন্সীর।
মুন্সী ২০১৩ সালে শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চের একজন সংগঠক এবং অনলাইন ব্লগারদের সংগঠনের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। মুন্সী ২০১৫ সালের নভেম্বর থেকে জার্মানির কোলনে বসবাস করছেন। ব্লগার নীলাদ্রীর মুত্যুর কয়েক দিনের মাথায় তিনি দেশ ত্যাগ করেন।
জীবনের ঝুঁকিতে থাকা এই পর্যন্ত ৫০ জন ব্লগার বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আশ্রয় নিয়েছেন। তাদের মধ্যে অনেকে আত্মীয়তার সূত্রে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও কানাডায় চলে গেছেন। মুন্সীসহ ২০ জন ২০১৩ সালের পর ইউরোপের মূল ভূখন্ডে আশ্রয় প্রার্থনা করেছেন। প্রাইভেট ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে বৃত্তি ফেলোশিপের মাধ্যমে তারা দেশ ত্যাগ করেছেন। বিভিন্ন সংস্থায় কয়েক হাজার আবেদন জমা পড়েছে।
ব্লগার-লেখকদের ভাষ্য, সাংবাদিকসহ বাংলাদেশের কয়েক হাজার নাগরিক বিভিন্ন মৌলবাদী গোষ্ঠীর তীক্ষ èনজরদারির মধ্যে রয়েছে। এপ্রিলে যেহেতু হত্যাকা-ের ঘটনা বেশি ফলে অনুমিত হচ্ছে দেশ ত্যাগের সংখ্যা আরও বাড়বে।
বিদেশে চলে যেতে পারার পরিণতিতে ব্লগাররা যে নিরাপদ হয়ে গেলেন এমনটি মনে করার কারণ নেই। ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে ‘আনসারউল্লাহ বাংলা টিম’ বিশ্বব্যাপী যে হিটলিষ্ট প্রকাশ করে তাতে সুইডেন, যুক্তরাজ্য, কানাডা, জার্মানি এবং যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানরত ব্লগারদের লক্ষ্য করেই ওই হুমকি প্রদান করা হয়। হুমকিতে বলা হয়, ব্লগারদের বিশ্বের যেখানে পাওয়া যাবে সেখানেই কতল করা হবে।
দুই বছর আগে বাংলাদেশ ত্যাগ করেছেন সাংবাদিক ও ব্লগার নির্ঝর মজুমদার। কোন দেশে তার অবস্থান তা গোপন রেখে তিনি বলেন, সিরিয়ার জিহাদি গ্রুপের অনলাইন আলোচনায় তিনি তার নাম দেখেছেন। উল্লেখ্য, নির্ঝরের লেখায় সশস্ত্র বাহিনী ও ইসলামপন্থীরা যারপরনাই বিরক্ত। নির্ঝর বলেন, এসব তথ্য পাওয়ার পর তার আশ্রয়দানকারী দেশের পুলিশ তাকে নিরাপদ আশ্রয়ের ব্যবস্থা করেন এবং পাবলিক রেকর্ড থেকে তার নাম সরিয়ে ফেলেন যাতে তাকে চিহ্নিত করা কঠিন হয়।
নির্ঝর বলেন, আমাকে সামাজিক মাধ্যম ব্যবহার যথাসম্ভব কমিয়ে ফেলতে বলা হয়, এমনকি পরিবারের সাথে যোগাযোগ কমাতে বলেছে। নির্ঝর বলেন, ইসলামপন্থীরা একই সাথে নিরাপত্তা সংস্থা সমূহ তার পরিবারের উপর হুমকি অব্যাহত রেখেছে।
২০০৪ সালে ঢাকায় আক্রান্ত হওয়ার পর লেখক হুমায়ূন আজাদ জামার্নিতে পালিয়ে যান। কয়েক সপ্তাহ পরে মিউনিখে সন্দেহজনক অবস্থায় তার লাশ পাওয়া যায়। তার মেয়ে অনন্যা আজাদের (২৬) স্মৃতিতে এখনো তার পিতার করুন পরিণতির স্মৃতি জাগরুক। ব্লগার অনন্যাও তার পিতার মত আতঙ্কে আছেন। একইভাবে নিরাপত্তা কামনা করেছেন।
অনন্যার ভাষায়, ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বহু জামায়াতির বাস। ইসলামপন্থীরা যে কোন জায়গায় যে কোন ঘটনা ঘটাতে পারে। প্যারিস ও ব্রাসেলস যে নিরাপদ নয় তা প্রমাণিত। সেক্ষেত্রে আমরা বলতে পারি না ইউরোপ নিরাপদ। ২০১৫ সালে হামবুর্গে আসার পর তার নাম বিশ্বব্যাপী ঘোষিত হিট লিষ্টে প্রচার করা হয়।
এদিকে হুমায়ূন আজাদ দেশ ত্যাগের আগে বলেছিলেন, তাকে বাসায় তালাবদ্ধ করে রাখা হতো। কোন কারণে বাসার বাইর
ে বেরুতে হলে তাকে অবশ্যই হেলমেট পরে বেরুতে হতো। তবে আজাদকে বাংলাদেশে তার শেষ দিনগুলোতে যারা দেখেছেন তারা জানেন কি রকম আতঙ্কের মধ্যে তিনি দিন কাটাতেন।
মুন্সী বলেন, জার্মানিতে আসার কয়েক সপ্তাহের মধ্যে একটা ডিনার পার্টিতে একজন তার সাথে খারাপ ব্যবহার করেন। আমি বাংলাদেশে কি করতাম লোকটি তা জানতে চায়। এমনকি সে আমার সাথে ছবি তুলতে চায়। পরে আমি জানতে পারি ওই লোকটি জামায়াত সমর্থক এবং আশ্রয় প্রার্থী।
বাংলাদেশের ভংগুর রাজনীতির প্রেক্ষাপটে মৌলবাদীরাই যে শুধুমাত্র লেখকদের দুশমন তা নয়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আমেরিকায় বসবাসরত এক সাংবাদিক জানান, আওয়ামীলীগ সরকারের শাসনামলে পুলিশি বাড়াবাড়ির বিরুদ্ধে লিখতে গিয়ে তার বিরুদ্ধে মামলা হলে তিনি আমেরিকায় আশ্রয় প্রার্থী হন।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের পরিস্থিতি এমন ভয়াবহ যে, সরকার বা মৌলবাদী কারো বিরুƒদ্ধে কিছু বলতে গেলেই বিপদ। এক বছর চুপচাপ থাকার কারণে তার মনে হচ্ছে তার দেশে ফেরা নিরাপদ হবে। আমি ভয়ঙ্কর সব বিযয় নিয়ে কিছু লেখা বন্ধ করে দিয়েছি। কেন না নিরিবিলি থাকাটাই সর্বোত্তম পন্থা।
মুন্সী বলেন, ২০১৩ সালের আগে তুলনামূলকভাবে ধর্ম নিয়ে লেখা নিরাপদ ছিল। কিন্তু এখন সে অবস্থাটা নেই। এখন সকলেই নিশ্চুপ। একথায় অবশ্য সবাই একমত নন।
আজাদের ভাষ্য, যদি আপনি না লেখেন তাহলে মানুষ জানবে কি করে যে, ইসলামী মৌলবাদীরারা মানবতার দুশমন। মানবিকতার ব্যাপক লঙ্ঘনকে পাশ কাটিয়ে রেখে বৃহত্তর ইসলামিক স্বার্থের কথা বলা হচ্ছে। যদি আমরা না লিখি মৌলিবাদীরা জিতে যাবে।
মুন্সী বলেন, তিনি অবসরে তার স্মৃতিকথা লিখছেন। তার জীবনের ভয়ার্ত ও কালো অধ্যায়ই রচনার বিষয়বস্তু। দেশের বাইরে থাকা ব্লগাররা যাই বলুন না কেন তাদের দেশে ফেরার সম্ভাবনা সামান্যই। এখন সংখ্যালঘু ও সমকামী সংগঠকরা বেশি হামলার স্বীকার হচ্ছেন।
নির্ঝর বলেছেন, এখন কোন অর্থেই বাংলাদেশকে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র বলা যাবে না। আমার বিশ্বাস বাংলাদেশ আর ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে পরিণত হবে না।
সূত্র: দ্য হিন্দু
অনুবাদ: কায়কোবাদ মিলন