ওয়ালি উল্লাহ সিরাজ: ছুটে আসছে রেলগাড়ি। মা বিপদটা ঠিক বুঝতে পেরেছিলেন। তাই তিনি শিশুসন্তানদের দ্রুত বাস থেকে নেমে যেতে বলেন। তারা নেমে যায়। এরপরই তিনিও বাস থেকে লাফ দেন। কিন্তু ততক্ষণে বাসটির একাংশ ছুটে আসা রেলগাড়ির ধাক্কায় দুমড়েমুচড়ে যায়। বাসের সামনের অংশটা ছিল রেললাইনের ওপর। ধাক্কা লেগে বাসটি ঘুরে ইঞ্জিনের সামনে চলে আসে। এসময়ই চাকার নিচে চাপা পড়েন মা বিবি মরিয়ম (৩৫)। তিন ছেলে দাঁড়িয়ে দেখল মায়ের করুণ মৃত্যুর দৃশ্য। মুহূর্তের আকস্মিকতায় ভাষাহীন তিন সন্তান। নির্বাক চোখে কেবলই মাকে খুঁজে ফিরছে তারা। এমনই ছিল গত সোমবার বেলা ১১টায় চট্টগ্রাম নগরের ষোলশহর ২ নম্বর গেট রেলক্রসিংয়ের দুর্ঘটনার দৃশ্য।
বাংলাদেশে ট্রেন দুর্ঘটনার খবর এটাই প্রথম না। বরং যুগান্তরে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ‘রেলপথ মন্ত্রণালয় ও রেলওয়ে বিভাগসহ সংশ্লিষ্ট সূত্রের তথ্য অনুযায়ী, প্রতি মাসে ট্রেন লাইনচ্যুতিসহ রেলক্রসিংয়ে দুর্ঘটনা ঘটে কমপক্ষে ১০০ থেকে ১১০টি। এর মধ্যে ৭৫ শতাংশ লাইনচ্যুতির ঘটনা ঘটছে শুধু লাইনে পর্যাপ্ত পাথর না থাকার কারণে। তাছাড়া ৪০ থেকে ৬০ বছরের পুরনো মেয়াদ উত্তীর্ণ ইঞ্জিন ও বগি, অদক্ষ চালক এবং রেলক্রসিংয়ের গার্ডদের অনুপস্থিতির কারণে ঘটে বাকি ২৫ শতাংশ দুর্ঘটনা। ২ হাজার ৮৭৮ কিলোমিটার রেলপথে মোট ২৫৪১টি রেলক্রসিংয়ের মধ্যে প্রায় ১৩০০ রেলক্রসিংই অবৈধ। আইন না মানা, অবৈধ ক্রসিংগুলোতে গেটম্যান না থাকা, বৈধগুলোতে পর্যাপ্ত লোকবল না থাকা ও ক্রসিং ঘেষে অবৈধ বাজারের কারণে বছরের পর বছর ধরে এসব ট্রেন দুর্ঘটনা ঘটছে। কিন্তু সন্তানদের বাঁচিয়ে মায়ের প্রাণ বিলিয়ে দেয়ার ঘটনা হয়তো এটাই প্রথম। তাই ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে প্রতিটি মানুষের কাছে তার মা অতি মূল্যবান। শুধু মানুষ কেন? পৃথিবীর প্রতিটি প্রাণীই তার মায়ের কাছে ঋণী। সে ঋণ শোধ করার কোনো উপকরণ আল্লাহপাক দুনিয়ায় সৃষ্টি করেননি।
ইসলামও মায়ের মর্যাদাকে মহিমান্বিত করেছে। এ বিষয়ে আল্লাহপাক পবিত্র কোরআনে ইরশাদ করেছেন, ‘আমি মানুষকে তার মা-বাবার সঙ্গে (সদাচরণের) নির্দেশ দিয়েছি। তার মা কষ্টের পর কষ্ট ভোগ করে তাকে গর্ভে ধারণ করে। আর তার দুধ ছাড়ানো হয় দুই বছরে; সুতরাং আমার শুকরিয়া ও তোমার মা-বাবার শুকরিয়া আদায় করো”- (সুরা লুকমান : ১৪)।
হাদিসে এসেছে। একবার এক সাহাবি রাসুল (সা.)-এর কাছে এসে জিজ্ঞাসা করলেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ! আমার কাছে কে উত্তম ব্যবহার পাওয়ার বেশি হকদার? তিনি বললেন, মা। লোকটি বলল, তারপর কে? তিনি বললেন, তোমার মা। সে বলল, তারপর কে? তিনি বললেন, তোমার মা। সে বলল, তারপর কে? তিনি বললেন, তোমার বাবা- (বোখারি-মুসলিম)।
মায়ের ত্যাগের তুলনা কোন হয় না। সন্তানের জন্য তুলনামূলকভাবে মা-ই বেশি ত্যাগ স্বীকার করেন। গর্ভধারণ, দুধপান, রাত জেগে সন্তানের তত্ত্বাবধানসহ নানাবিধ কষ্ট একমাত্র মা-ই সহ্য করেন। তা ছাড়া সন্তানের প্রতি মা-ই সবচেয়ে বেশি যতœবান ও বেশি আদর-সোহাগ করে থাকেন। মায়ের তুলনা শুধুই মা।
ইসলাম মাকে আরো সম্মান দিয়েছে। রাসুল (সা.) বলেন, ‘মা-বাবাই হলো তোমার জান্নাত এবং জাহান্নাম’- (মিশকাত, পৃ. ৪২১)। অন্য হাদিসে এসেছে, ‘যখন কোনো অনুগত সন্তান নিজের মা-বাবার দিকে অনুগ্রহের নজরে দেখে, আল্লাহ তায়ালা তার প্রতিটি দৃষ্টির বিনিময়ে একটি করে কবুল হজের সাওয়াব দান করেন।-(বায়হাকি-মিশকাত)