সোহেল সানী, দিনাজপুর প্রতিনিধি : বাংলাদেশ রেলওয়ের পশ্চিমজোনের সর্ববৃহৎ রেল জংশনের নাম পার্বতীপুর। প্রয়োজনীয় পদক্ষেপের অভাবে দিনাজপুরের পার্বতীপুর রেলওয়ে জংশনে ৪৫ বছরেও আধুনিকতার ছোঁয়া লাগেনি। সামান্য কিছু উন্নয়নমূলক কাজের পদক্ষেপ নেয়া হলেও বাস্তব সম্মত পরিকল্পনার অভাবে তাও ভেস্তে গেছে। নানারকম জটিলতার কারণে রেলওয়ে পশ্চিমাঞ্চলীয় জোনের বৃহৎ এ জংশনটি যুগ যুগ ধরে একইভাবে অবহেলিত রয়ে গেছে।
দিনাজপুর জেলার পার্বতীপুরের বড়পুকুরিয়া কয়লাখনি, মধ্যপাড়া কঠিন শিলা খনি, ২৫০ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক বড়পুকুরিয়া তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র, পার্বতীপুর উত্তর-পশ্চিম মৎস্য সম্প্রসারণ প্রকল্প, রেলওয়ে কেন্দ্রীয় লোকোমোটিভ কারখানা (কেলোকা), পার্বতীপুর রেলহেড অয়েল ডিপো, রেলওয়ে ডিজেল কারখানা, পার্বতীপুর বীর উত্তম শহীদ মাহবুব সেনানিবাস ও বিদেশী মিশনারী দ্বারা পরিচালিত ল্যাম্ব হাসপাতালের কারনে দেশি বিদেশি যাত্রীদের আনাগোনায় জংশনটির গুরুত্ব বেড়ে গেছে বহুগুণ।
কিন্তু ৪৫ বছরেও যাত্রী সেবার মান উন্নত হয়নি। রেলের তুলনায় বাস ভাড়া দেড় থেকে দুইগুণ বেশি হওয়ায় ও নিরাপত্তা ঝুঁকি কম থাকায় প্রতি মাসে যাত্রীসংখ্যা বাড়ার সাথে সাথে বাড়ছে রেলের রাজস্ব আয়ের পরিমাণও। অথচ রেলওয়ে পশ্চিমাঞ্চলীয় জোনের ১৩৭ বছরের পুরনো ও দেশের সর্ববৃহৎ ৪ লাইনের এ জংশন স্টেশনটি আজ নানাবিধ সমস্যায় জর্জরিত। স্বাধীনতার পরে এ রেল স্টেশনে আধুনিকতার কোন ছোঁয়া না লাগায় সমস্যাগুলো দিনেরপর দিন বেড়ে চলেছে।
রেল সূত্রে জানা যায়, ১৮৭৯ সালে স্থাপিত ১৩ হাজার ৯৪২ বর্গফুট আয়তনের এই রেলওয়ে জংশন দিয়ে বর্তমানে আন্তঃনগর ট্রেনসহ প্রতিদিন ৫২টি ট্রেন ঢাকা, চিলাহাটি, পঞ্চগড়, খুলনা, রাজশাহী, বুড়িমারী, বগুড়ায় যাতায়াত করে। প্রতি বছর এ স্টেশন হয়ে প্রায় ৪০ লাখ যাত্রী যাতায়াত করেন।
তবে ইঞ্জিন, যাত্রীবাহী কোচ, লোকোমোটিভ মাষ্টার ও গার্ডসহ অন্যান্য জনবল স্বল্পতার কারণে ২৪টি ট্রেন দীর্ঘদিন যাবত বন্ধ রয়েছে। ব্রডগেজ ও মিটারগেজ মিলে জংশনে মোট ৫টি প¬¬াটফর্ম রয়েছে। প¬¬াটফর্মগুলো নিচু ও খানা-খন্দের কারণে প্রতি বছর লাখ লাখ যাত্রীর ট্রেনে ওঠানামা করতে অবর্ণনীয় কষ্টের শিকার হতে হয়। তবে সম্প্রতি জোড়াতালি দিয়ে প¬¬াটফরমের কিছু স্থানে সংস্কার কাজ করা হয়েছে। ৪ ও ৫ নং প¬াটফরমের আংশিক উঁচু করা হয়েছে। তবে উঁচু করা হলেও এই দুই প¬াটফরমে প্রয়োজনীয় যাত্রীসেড তৈরি করা হয়নি। একটি আধুনিক সুইচ কেবিন ছাড়া এখানে আধুনিকতার কোনো ছোঁয়া লাগেনি। নেই পর্যাপ্ত যাত্রী ছাউনিও।
জংশনের একমাত্র ওভার ব্রীজটির অবস্থাও জরাজীর্ণ। ওভার ব্রীজে কোন ছাউনি না থাকায় রোদে পুড়ে ও বৃষ্টিতে ভিজে যাত্রীদের ওভারব্রীজ দিয়ে চলাচল করতে হয়। প¬াটফর্মগুলোতে পানীয় জলের সুব্যবস্থা না থাকায় যাত্রী সাধারণকে চরম ভোগান্তির শিকার হতে হয়। জংশনের বিভিন্ন ভবনের অবস্থাও অত্যান্ত নাজুক। স্টেশন মাস্টার, টিকিট কাউন্টার, যাত্রীদের বিশ্রামাগারসহ বিভিন্ন কক্ষের দেয়ালের পলেস্তারা খসে পড়লে সম্প্রতি সংস্কার করা হলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় যথেষ্ট নয়। এত বড় একটি রেলওয়ে জংশনে অনুসন্ধান বা তথ্য কেন্দ্র না থাকায় যাত্রী সাধারণ বেকায়দায় পড়েন। প্রয়োজনীয় বৈদ্যুতিক বাতির অভাবে সন্ধ্যার পর অন্ধকারে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে রেলওয়ে দক্ষিণ ইয়ার্ড এলাকা। এই ইয়ার্ডে সার্বক্ষণিক পড়ে থাকে কোটি কোটি টাকা মূল্যের রেলওয়ে যাত্রীবাহী কোচ। পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ না থাকার ফলে মাদকসেবী, চোরাকারবারি, ছিনতাইকারী ও ভাসমান পতিতাদের দখলে চলে যায় পুরো রেল এলাকা। সীমানা প্রাচীর না থাকায় ছিনতাইকারীরা অপরাধ সংঘটিত করে নির্বিঘেœ পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়।
জংশনের ৫নং প¬াটফর্মের পাশ দিয়ে জংশন সংলগ্
ন শহরকে আলাদা করতে এক সময় লোহার বেড়া দিয়ে পুরো স্টেশন এলাকা ঘিরে রাখা হয়েছিল। এতে অপরাধি ও বিনা টিকিটের যাত্রীরা সহজে স্টেশন থেকে পালিয়ে যেতে পারত না। কিন্তু রেল কর্তৃপক্ষের উদাসীনতার কারনে দীর্ঘদিনে সেগুলো চুরি হয়ে যাওয়ায় বর্তমানে পার্বতীপুর রেল স্টেশন ও শহর একাকার হয়ে গেছে। বৃহৎ এই রেলওয়ে জংশনটিতে বিভিন্ন আন্তঃনগর ট্রেনের বিশেষ করে পার্বতীপুর থেকে ঢাকার আসন সংখ্যা কম হওয়ায় ঢাকাগামী যাত্রীসাধারণকে চরম ভোগান্তিতে পড়তে হয়। এখানে যে পরিমাণ আসনের প্রয়োজন তার চেয়ে অর্ধেক আসন বরাদ্দ রয়েছে। রেলওয়ে জংশন এলাকায় প্রায় প্রতিটি লাইনেই পর্যাপ্ত ঘাস থাকায় গবাদি পশু অবাধে বিচরণ করে। এ কারণে রেল লাইনে অনেক গবাদি পশু কাটাপড়ার ঘটনাও ঘটেছে। নিয়মিত পরিস্কার পরিচছন্নতার অভাবে স্টেশনটির বিভিন্ন স্থানে নোংরা আবর্জনা ভরে থাকে। ছিন্নমূল অনেক মানুষ প¬াটফর্ম ও আশেপাশে এলাকায় বসত গড়ে তুলে অপরাধের আখড়ায় পরিণত করেছে।
জংশনের পণ্যবাহী ট্রেনের মালামাল ওজনের জন্য একমাত্র মেশিনটিও দীর্ঘদিন ধরে অচল হয়ে পড়ে রয়েছে। জংশনে চলাচলকারী ট্রলি ভ্যানগুলোতে রাবারের চাকা না থাকায় শব্দ দূষণ হচ্ছে প্রতিনিয়ত। রেলওয়ে জংশনের পূর্ব পাশ ঘিরে গড়ে উঠেছে কয়েকটি চোলাই মদের অবৈধ দোকান। ফলে জংশনের পরিবেশ বিনষ্ট হচ্ছে।
এ ব্যাপারে পার্বতীপুর রেল স্টেশন মাষ্টার জিয়াউল আহসানের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, জংশনের বিভিন্ন ভবনের অবস্থাও অত্যান্ত নাজুক। প¬াটফর্মগুলোতে পানীয় জলের সুব্যবস্থা না থাকা। সীমানা প্রাচীর না থাকা। প্রয়োজনীয় বৈদ্যুতিক বাতির অভাবে সন্ধ্যার পর অন্ধকারে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে রেলওয়ে এলাকা। যাত্রীদের বিশ্রামাগারসহ বিভিন্ন কক্ষ সংস্কার করা হলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় যথেষ্ট নয়। প্লাটফরমে প্রয়োজনীয় যাত্রীসেড তৈরি করা হয়নি। রেলওয়ে জংশনে অনুসন্ধান বা তথ্য কেন্দ্র না থাকায় যাত্রী সাধারণ বেকায়দায় পড়েন। এ জংশনটি দিয়ে বর্তমানে দেশী বিদেশী গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের যাতায়াত বেড়েছে। জংশনের নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার, যাত্রী সেবার মান বৃদ্ধি, ভবনগুলো আধুনিকায়ন করে ট্রেনে চোরাচালান বন্ধ করতে পারলে সাধারণ মানুষ আরো ট্রেন মুখী হবে। তিনি আরো জানান, প্রতি বছর এ জংশন স্টেশন থেকে ৭ কোটি টাকা রাজস্ব আয় হচ্ছে।