মাছুম বিল্লাহ : মেধার কাছে হার মানল দারিদ্র! চরম আর্থিক অনটনও যে সাফল্যের ক্ষেত্রে বাধা হতে পারে না, প্রমাণ করে দেখাল ভারতের আসামের সরফরাজ হুসেন। রাজ্যটির রাজধানী গুয়াহাটির উপকন্ঠ বেতকুচির সরফরাজ হুসেন এ বছর মাধ্যমিকের সেরা ছাত্রের সম্মান পেয়েছে। দারিদ্রের সঙ্গে রীতিমতো যুদ্ধ করে মেধার দৌড়ে প্রায় ৩ লক্ষ ৮০ হাজার ছাত্রকে টেক্কা দিয়ে শীর্ষস্থান দখল করেছে সে। বাবা একটি ছোট হোটেলের সামান্য কর্মচারী । দু’বেলা দু’ মুঠো ভাতের জোগাড় করতে মাথার ঘাম পায়ে ফেলেন রোজ। কিন্তু, শত প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও থামতে দেননি ছেলের পড়াশোনা। সংসারের প্রবল ঝড়-ঝাপটার মধ্যে ছেলের আকাশছোঁয়া সাফল্যের খবরে হাউ হাউ করে কেঁদে ফেলেন বাবা আজলাল হুসেন।
বেতকুচি এলাকার একটি চিলার ওপর সরফরাজের ঘর। এক হাঁটু জল-কাদা মাড়িয়ে যেতে হয় সেখানে। ঘর বলতে তিন ইঞ্চি ওয়ালের দুটি ছোট ঘর। ঢাকার অভাবে ইটের দেওয়ালে পড়েনি পলেস্তারা। অভারের জ্বালায় দু’পাটি কাঠের জানালাও লাগানো হয়ে ওঠনি। বর্ষা এলে মরচে ধরা টিনের চাল ফুটো হয়ে টপটপ করে পানি পড়ে মেঝে ভেসে যায়। ঘরের এক কোণে সরফরাজের পড়ার টেবিল। সেটাও দান করেছেন আফজাল যে হোটেলে কাজ করেন তার মালিক। ব্যস, আসবাবপত্র বলতে এটুকুই। গরিব এক হোটেল কর্মীর টিনের চালের এই ঘরটিই এখন সারা আসাম রাজ্যের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। কারন, এখানে থেকেই চরম সংগ্রাম করে উঠে এসেছে যে ছেলটি, সে এবারের মাধ্যমিকের প্রথম হয়েছে। টিউশন ছাড়াই সবাইকে চমকে দিযে ৬০০-র মধ্যে পেয়েছে ৫৯০ নম্বর। সব বিষয়ে লেটার নম্বর পেয়ে মেধা তালিকায় দখল করেছে শীর্ষ স্থান।
ছিপছিপে গড়নের এক লাজুক ছেলের সাফল্যে ভিড় জমেছে আফজালের বাড়িতে। প্রতিবেশীরা তো বটেই, খবর পেয়ে দূর-দুরান্ত থেকেও ছুটে এসেছেন অগণন মানুষ। সরফরাজকে তারা দু’হাত ভরে দোয়া করেছেন।
ছেলের কৃতিত্বে গর্বিত আফজাল বলেন, ‘ অনেক কষ্ট করে ছেলেকে স্কুলে ভর্তি করিয়েছি। কখনও খাবার জোগাড় করতে পেরেছি, কখনও পারিনি, তা বলে ছেলের পড়াশোনা বন্ধ হতে দেইনি। এক কাপড়ে স্কুলে গেছে। তবুও কাপড় কিংবা ভাল খবারের জন্য বায়না ধরেনি। পরিবার প্রতিপালনে ছাগল পুষতাম। ছাগল বিক্রি করে দু’পয়সা বাড়তি রোজগার হতো। তা দিয়ে বাই-খাতা কিনে দিতাম। আজ আল্লাহ আমাদের দিকে মুখ তুলে তাকিয়েছেন। জীবনে অনেক দুঃখ পেয়েছি, চোখে কখনও পানি আসেনি। আজ ছেলের সাফল্যে চোখের পানি আর ধরে রাখতে পারিনি।’
বিদ্যাভারতী পরিচালিত অসমিয়া মাধ্যমের স্কুল শংকরদেব শিমু নিকেতনে অঙ্কুর শ্রেণিতে ছোট বেলায় ভর্তি হযেছিল সরফরাজ। বেতকুচির জ্যোতিনগরে পানি-কাদা মাখা দীর্ঘ পথ পেরনোর পর দেখা মিলবে ওই স্কুলের। জরাজীর্ণ চেহারার স্কুলটির অবস্থাও তথৈবচ। দালানবাড়ি তো দূর, পড়াশোনার সামান্য অবকাঠামোও নেই এখানে। আশপাশের মূলত গরিব-গুরবো পরিবারের ছেলেমেয়েরাই এই স্কুলে শিক্ষার্থী। অখ্যাত স্কুলটির আচার্য-আচার্যারা (শিক্ষকরা এই নামেই পরিচিত) হঠাৎ করেই যেন প্রচারের আলোয় চলে আসেন। তাদেরই এক ছাত্রের অসামান্য কৃতিত্বের দৌলতে সারা রাজ্যের মানুষ এই স্কুলের নামে জেনে গিয়েছে।
এমন চমকপ্রদ সাফল্যেও মাথা ঘুরে যায়নি তার। সরফরাজ জানায়, ‘রাজ্য সেরা হতে পেরে দারুন আনন্দ লাগছে বটে। তবে স্ট্যান্ড করাটা বড় কথা নয়, ভবিষ্যৎ জীবনে আদর্শ মানুষ হওয়াটাই বড়। ছেলেবেলা থেকেই খুব কষ্ট করছি। পড়াশোনার জন্য প্রচুর খাটতে হয়েছে। ভাল রেজাল্ট করব জানতাম। কিন্তু মেধা তালিকার একেবারে শীর্ষে থাকবো এটা ভাবতে পারিনি। একটা কতা ঠিক, দৃঢ়তা থাকলে গিিরবি বাধা হতে পারে না। সাফল্যের জন্য আচার্য-আচার্যাদের অশেষ শ্রদ্ধা জানাচ্ছি। সবার ওপরে মা বাবার ঋণ শোধ করতে পারবো না কোনও দিন।‘
ভবিষ্যতে একজন সফল ইঞ্জিনিয়ার হতে আগ্রহী সর
ফরাজের পরামর্শ, ছাত্রছাত্রীদের পড়াশোনার প্রতি মোনোযোগী হওয়াটাই সবচেয়ে বড় ব্যাপার। মোবাইল, ফেসবুক,হোয়াটস অ্যাপ ইত্যাদি যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলাই ভাল।
এদিকে আফজাল হুসেনের সাফল্যে অভিনন্দন জানিয়েছেন রাজ্যটির শিক্ষামন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মাসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনের নেতারা। পাশাপাশি তারা ভবিষ্যত পরাশোনার যাবতীয় খরব বহনেরও আশ্বাস দিয়েছে।- দৈনিক যুগশঙ্খ।