আন্তর্জাতিক ডেস্ক: তখন গ্রীষ্মকাল। ১৪৫৩ সালের ২৯ মে। দ্বিতীয় সুলতান মেহমেতের নেতৃত্বে কনস্টানটিনপোলের দেয়াল ভেঙে দেয় অটোমান সেনাদল। এই শহরটিই ছিলো বাইজেন্টাইন সা¤্রাজ্যের শেষ ঘাঁটি ও রাজধানী শহর। ইতিহাসে হয়তো ভালো-মন্দে মিলিয়ে এক রক্তাক্ত দিন হিসেবেই চিহ্নিত। যেমন ইংল্যান্ডের ইতিহাসে ১০৬৬ সাল। তবে তুরস্কে বাইজেন্টাইন রাজধানী জয়ের দিনটি বিশেষ মর্যাদার সঙ্গে দেখা হয়। এর সঙ্গে যুক্ত করা হয় ভাবাদর্শকে। তবে আমেরিকার মানুষ যেমন তর্কে বসে তাদের জাতির পিতা নিষ্ঠাবান খ্রিস্টান ছিলেন কি ছিলেন না, তেননি তুর্কিরাও ওই সময়ের বীর মেহমেতের ওপর বিভিন্ন ধরনের গুণ বা দোষ আরোপ করে।
তুরস্কের রাজনীতি নিয়ে যারা খোঁজ খবর রাখেন, তারা অবশ্যই জানেন অটোমান ইতিহাসকে এখন বড় বেশি ধর্মীয় চরিত্র দেয়ার চেষ্টা চলছে। ক্ষমতাসীন জাস্টিস এন্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি সুলতান দ্বিতীয় মেহমেতকে তুর্কি রাজনৈতিক শাসক ও যোদ্ধার চেয়ে মুসলিম বীর হিসেবে প্রচার করতে বেশি আগ্রহী। সাম্প্রতিক সময়ে ১৪৫৩ সালের বিজয়কে যে মাত্রায় পালন করা হচ্ছে, তাতে তাই প্রতীয়মান হয়। উদযাপন অনুষ্ঠান শুরু হয় একটি হাদিসকে উল্লেখ করে। ‘একদিন কনস্টানটিপোল বিজয় হবে। যে সেনাপতি বিজয় লাভ করবে সে মহান, তার সৈন্যবাহিনী মহান’ । তার পর দেখানো হয় মেহমেতের সৈন্যরা যুদ্ধের আগে নামাজ পড়ছেন আর, শহরের ভেকতর বাইজেন্টাইন পাদ্রিরা মুসলিমদের রক্তের জন্য পিপাসার্ত।
ছয় দশক আগে, এই বিষয়টি এমনভাবে দেখা হতোনা তুরস্কে। ১৯৫৩ সালে যখন তুরস্কে বাইজেন্টাইন বিজয় দিবস পালন করা হয়, তখন মেহমেতকে চিত্রিত করা হয়েছিলো একজন সম্মানিত সেক্যুলার শাসক হিসেবে। তুরস্কের বুদ্ধিজীবী ও রাজনীতিকরা তার ইহজাগতিকতার প্রশংসা করেছিলেন। ইউরোপের রেনেসাঁ কালের শিল্পকর্মের প্রতি তার ভালোবাসা, গ্রিসের দর্শন ও বিজ্ঞানে তার জ্ঞান, তার ব্যবহৃত সামরিক প্রযুক্তি প্রশংসিত হয়েছে তাকে স্মরণ করার সময়। হাগিয়া সোফিয়া গির্জাকে ধংস না করে মসজিদে রুপান্তর করাকেও প্রশংসা করা হয়েছে। যাকে বলা হয়েছে এটা সুলতান মেহমেতের প্রজ্ঞার নিদর্শন। এর পর মোস্তফা কামাল আতাতুর্ক এ ভবনকে যাদুঘরে রুপান্তর করেন। ওই সময়ে দশ দিন ধরে উদযাপিত হয়েছিলো ইস্তাম্বুল বিজয়ের ৫০০ বছর। সেক্যূলার তুরস্কে এই উদযাপনে ছিলো গার্ডেন পার্টি থেকে শুরু করে ফ্যাশন শো পর্যন্ত, নানা আয়োজন। সরকারের পক্ষ থেকে একটি সিগারেট বের করা হয়েছিলো সুলতানের নামে, তার ছবিসহ। ১৯৫৩ সালের ওই উদযাপন ছিলো অটোমান সৌর্যের নয়া বিকাশের নমুনা। আর আজকের উদযাপন দেখে মনে হয় তুর্কিরা মেহমেতের সেক্যুলার ও মুসলিম দুই রূপেই সমান মুগ্ধ।
জঙ্গিগোষ্ঠি আইএসও সুলতান মেহমেতকে ব্যবহার করতে পিছপা হয়নি। তারা তাদের এক প্রকাশনায় সুলতানকে প্রশংসা করেছে, চ্যালেঞ্জ করেছে তুর্কি সরকারকে। বলেছে মহানবী (স:)-এর বাণী তখনই পরিপূর্ণ হবে, যখন আইএস খিলাফত ইস্তা¤ু^ল বিজয় করবে।
তুরস্কের সব মতের মানুষই সুলতান মেহমেতকে তাদের মতো করে ব্যাখ্যা করে। নিজেদের বীর সন্তান মনে করে। তিনি ছিলেনও সত্যিকারের বীর। তবে কেবল কনস্টানটিপোল বিজয়ই সুলতান মেহমেতের একমাত্র কৃতিত্ব নয়- একথা মনে রাখা জরুরি। মুসলিম, তুরস্ক ও সারা পৃথিবীর জন্য সুলতান দ্বিতীয় মেহমেত একজন বীর, প্রজ্ঞাবান শাসক ও ইতিহাসের নায়কোচিত চরিত্র। ওয়াশিংটন পোস্ট।