ডেস্ক রিপোর্ট : ‘এক নেতার এক পদ’ নিয়ম কার্যকর করা দুরূহ হয়ে পড়ছে বিএনপিতে। শতাধিক নেতার একাধিক পদ থাকলেও বেশির ভাগই তা ছাড়তে নারাজ তৃণমূলে বিপর্যয় হবে এই অজুহাতে। এ ছাড়া বেশির ভাগ নেতাই উদাহরণ হিসেবে সামনে টেনে আনছেন রুহুল কবীর রিজভী আহমেদের বিষয়টি। কারণ সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব হওয়ার পরও তিনি দলের দপ্তর সম্পাদকের পদ আঁকড়ে রয়েছেন। এ নিয়ে দলের সর্বস্তরে কথা হচ্ছে।
গত ১৯ মার্চ বিএনপির জাতীয় কাউন্সিলের মাধ্যমে দলের গঠনতন্ত্রে ‘এক নেতার এক পদ’ নীতি সংযোজিত হয়। এরপর গত ৩ জুন চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া একাধিক পদ ছাড়ার ব্যাপারে তাঁর কঠোর নির্দেশনার কথা মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের মাধ্যমে নেতাদের জানান। তাঁর এ নির্দেশনার ১০ দিন পর গতকাল পর্যন্ত মাত্র চারজন একাধিক পদে না থাকার কথা চিঠি দিয়ে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে জানিয়েছেন। তাঁরা হলেন বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আবদুল আউয়াল মিন্টু, যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল এবং সহদপ্তর সম্পাদক আবদুল আউয়াল খান ও আবুল হাশেম বক্কর। এর আগে মহাসচিব হওয়ার পর বাড়তি পদ ছাড়েন মির্জা ফখরুল।
মিন্টু ঢাকা মহানগরী বিএনপির এক নম্বর যুগ্ম আহ্বায়কের পদ থেকে, আলাল যুবদলের সভাপতির পদ থেকে, আউয়াল মৎস্যজীবী দলের সাংগঠনিক সম্পাদকের পদ থেকে পদত্যাগ করেছেন। অন্যদিকে বক্কর নব ঘোষিত কমিটির সহসাংগঠনিক সম্পাদকের পদ ছেড়ে চট্টগ্রাম মহানগরী বিএনপির সাধারণ সম্পাদক হওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন বলে জানা গেছে। এ ছাড়া নতুন কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক শাহাদাত হোসেন মৌখিকভাবে জানিয়েছেন, চট্টগ্রাম মহানগরী বিএনপির সভাপতি করা হলে তিনি ওই পদ ছেড়ে দিতে রাজি আছেন।
এই চারজনের বাইরে একমাত্র মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর মহাসচিব হওয়ার পরের দিনই দুটি পদ থেকে পদত্যাগ করেন। তিনি বলেন, “দলের জাতীয় কাউন্সিলের মধ্য দিয়ে গঠনতন্ত্রে ‘এক নেতার এক পদ’ নীতি সংযোজন করার পর আমি বাকি দুটি ছেড়ে দিয়েছি। এখন অন্য নেতাদেরও ওই পথ অনুসরণ করার কথা চেয়ারপারসন বলে দিয়েছেন। তবে কোনো এলাকায় বড় ধরনের সমস্যা থাকলে সেটি চেয়ারপারসনের বিবেচ্য বিষয়।”
কাউন্সিলের পর গত ৩ জুন দলের নতুন কার্যনির্বাহী কমিটির প্রথম বৈঠকে একাধিক পদ ছাড়ার ব্যাপারে খালেদা জিয়ার কঠোর নির্দেশনার কথা মির্জা ফখরুল উপস্থিত নেতাদের জানান। তিনি বলেন, যাঁরা একাধিক পদে রয়েছেন তাঁদের পছন্দের পদটি রেখে বাকিগুলো ছেড়ে দিতে হবে। অবশ্য ওই বৈঠকে যুগ্ম মহাসচিব মজিবর রহমান সারোয়ারসহ বেশ কয়েকজন বলেন, দীর্ঘদিন ধরে তৃণমূলে রাজনীতি করে যাঁরা এলাকা ধরে রেখেছেন তাঁদের হঠাৎ করে জেলা ছেড়ে দেওয়া ঠিক হবে না। তাঁদের যুক্তি, এভাবে হঠাৎ করে এলাকার রাজনীতি ছাড়লে দলে বিপর্যয় দেখা দেবে। তৃণমূলের সংগঠন এলোমেলো হয়ে যাবে।
ওই বৈঠকের ১০ দিনের মধ্যে মাত্র চার নেতার পদত্যাগের খবর জানা গেল। যদিও নতুন কমিটির ৪২ জনের মধ্যে অধিকাংশ নেতাই একাধিক পদে রয়েছেন। তবে সবচেয়ে বেশি কথা হচ্ছে রিজভী আহমেদকে নিয়ে। কারণ একাধিক পদ ছাড়ার প্রসঙ্গ উঠলেই সবাই তাঁর প্রসঙ্গ টেনে এনে বলছেন, ‘আগে রিজভী দপ্তর ছাড়ুক; তারপর আমরা ছাড়ব।’ জানা গেছে, দলের এমন পরিস্থিতির তথ্য জেনে সম্প্রতি গুলশান কার্যালয়ে গিয়ে এ বিষয়ে কথা তুলেছেন স্থায়ী কমিটির প্রবীণ সদস্য এম তরিকুল ইসলাম। খালেদা জিয়াকে উদ্দেশ করে তিনি বলেন, ‘ম্যাডাম, আপনি রিজভীকে দপ্তর ছাড়তে বলুন। কারণ দপ্তর সাধারণত মহাসচিবের নির্দেশনায় চলে। সুতরাং তাঁকে তাঁর মতো দপ্তর চালাতে দেওয়া উচিত।’ এ ছাড়া সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব হওয়ার পর রিজভী বাসায় গেলে তাঁকেও দপ্তর ছেড়ে দেওয়ার কথা বলেন তরিকুল। তবে তিনি এখনো ওই পদ ছাড়েননি। কার্যনির্বাহী কমিটির প্রথ
ম বৈঠকে পরিচয়পর্বে নিজের এই অবস্থান ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘আমি আগে থেকেই দপ্তরের দায়িত্বে ছিলাম। যেহেতু এখনো কাউকে এর ভার দেওয়া হয়নি, তাই চেয়ারপারসন আমাকে কাজ চালিয়ে যেতে বলেছেন।’
রিজভী ছাড়াও যুগ্ম মহাসচিবদের মধ্যে মজিবর রহমান সারোয়ার বরিশাল মহানগরী সভাপতি, খায়রুল কবীর খোকন নরসিংদী জেলা বিএনপির সভাপতি, হাবিব-উন-নবী খান সোহেল ঢাকা মহানগরী বিএনপির সদস্যসচিব, হারুন-অর-রশীদ চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলা বিএনপির এক নম্বর সদস্য ও আসলাম চৌধুরী চট্টগ্রাম উত্তর জেলা বিএনপির আহ্বায়ক পদে রয়েছেন।
সাংগঠনিক সম্পাদকদের মধ্যে ফজলুল হক মিলন গাজীপুর জেলা বিএনপির সভাপতি, নজরুল ইসলাম মঞ্জু খুলনা মহানগরী বিএনপির সভাপতি, রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু নাটোর জেলা বিএনপির সভাপতি, বিলকিস শিরিন কেন্দ্রীয় মহিলা দলের যুগ্ম সম্পাদক ও বরিশাল জেলা বিএনপির সিনিয়র সহসভাপতি, আসাদুল হাবিব নীলফামারী জেলা বিএনপির সভাপতি পদে রয়েছেন। এমরান সালেহ প্রিন্স আগে সহপ্রচার সম্পাদক পদে থাকলেও এখন ওই পদ বিলুপ্ত হয়ে গেছে।
জানতে চাইলে বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক খায়রুল কবির খোকন বলেন, ‘যদি সবাই ছাড়ে এবং কেন্দ্র যদি এক নেতার এক পদ নীতির বাস্তবায়ন চায় তাহলে অবশ্যই জেলা (নরসিংদী) সভাপতির পদ ছেড়ে দেব।’ তবে তার আগে তৃণমূলের বাস্তবতা বুঝতে হবে। হঠাৎ করে কাউকে দায়িত্ব ছেড়ে দেওয়া যায় না। আগে কাউন্সিল করে দল গুছিয়ে তারপরে ছাড়তে হবে, এ জন্য সময় লাগবে—যোগ করেন খোকন।
আরেক যুগ্ম মহাসচিব মজিবর রহমান সারোয়ার বলেন, হঠাৎ করে জেলার রাজনীতি কার হাতে ছেড়ে দেব? সেখানে আগে যোগ্য নেতৃত্ব গড়ে তোলা দরকার। তা ছাড়া কেন্দ্র যতই বলুক, তারা কি তৃণমূল বা এলাকায় আন্দোলনের দায়িত্ব নেবে? এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আরো অনেকে একাধিক পদে আছেন। দেখি তাঁরা কী করেন।
সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু বলেন, ‘চেয়ারপারসনের নির্দেশনা বিষয়ে মহাসচিব সেদিন বৈঠকে বলেছেন, আমরা শুনেছি। এখন দেখা যাক, এই নীতির বাস্তবায়ন কতদূর এগোয়। কারণ তিল তিল করে এলাকায় সংগঠন গড়ে তুলেছি। এখন কেন্দ্র বললে ছেড়ে দেব। তবে বাস্তব পরিস্থিতিও কেন্দ্রকে বুঝতে হবে। হঠাৎ করে চাইলেই ছাড়া যায় না।’ কালের কন্ঠ