//আবাসন প্রকল্পের কাজে গতি নেই//
ডেস্ক রিপোর্ট : স্বল্প ও মধ্যম আয়ের মানুষের আবাসন সংকট দূর করতে ২০১১ সালের শুরুর দিকে রাজধানীর উত্তরা আদর্শ আবাসিক শহর (তৃতীয় পর্ব) প্রকল্পে ২২ হাজার ফ্ল্যাট নির্মাণের উদ্যোগ নেয় গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়। একই বছরের জুলাইয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ প্রকল্প উদ্বোধন করেন। এর পর পাঁচ বছর পার হলেও প্রকল্পের কাজ সম্পন্ন হয়নি। অথচ কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল গত বছর। কবে এটি শেষ হবে, তাও নিশ্চিত করতে পারেনি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। স্বল্প ও মধ্যম আয়ের মানুষের কাছে প্রকল্পের সব ফ্ল্যাট বিক্রি করা যাবে কি-না, তা নিয়ে দেখা দিয়েছে সংশয়। দাম বেশি হওয়ায় অনেকেই ফ্ল্যাট কিনতে আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। রাজউক একাধিকবার বিজ্ঞাপন দিয়েও তেমন সাড়া পাচ্ছে না। শুধু এ প্রকল্প নয়, সব পর্যায়ের মানুষের আবাসন নিশ্চিত করতে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নেওয়া সরকারের ২১টি প্রকল্পেরও এমন দুরবস্থা। আবাসন খাতকে শক্তিশালী করতে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় থেকে অনেক উদ্যোগের কথা বলা হলেও বাস্তবে এর প্রতিফলন ঘটছে না। এ খাতে প্রভাব বিস্তার করছে বেসরকারি কোম্পানিগুলো। এ পরিস্থিতিতে অনেকেরই প্রশ্ন, শুধু স্বপ্ন দেখাতেই পছন্দ করে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়? শুধু আবাসন খাত নয়, রাজধানীর বিভিন্ন সড়ক ও লেক উন্নয়ন প্রকল্পের কাজেও সময়ক্ষেপণ হচ্ছে।
তবে এমন অভিযোগ নাকচ করেছেন গৃহায়ন ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন। তিনি বলেন, মন্ত্রণালয়ের অগ্রাধিকার প্রকল্পে বিশেষভাবে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। অনেক সময় প্রকল্পের ডিপিপি তৈরির আগে সবকিছু যাচাই-বাছাইয়ে একটু সময়ক্ষেপণ হয়। তবে এমন যাতে না হয়, সে ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট সব কর্মকর্তাকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কাজ শুরুতে কোনো গাফিলতি সহ্য করা হচ্ছে না।
গত আট বছরে আবাসন খাতকে শক্তিশালী করতে ২১টি প্রকল্প নেওয়া হয়। এগুলোর বেশির ভাগই গত বছর শেষ হওয়ার কথা ছিল। তবে আমলাতন্ত্রিক জটিলতা, মন্ত্রণালয় ও সংস্থার সমন্বয়ের অভাব ও আবাসন খাতের স্বার্থান্বেষী মহলের প্রতিবন্ধকতায় কাজ এগোতে পারে না। সঠিক সময়ে প্রকল্পের ডিপিপি তৈরি হয় না এবং তৈরি হলেও তা অনুমোদনে সময়ক্ষেপণ হয়। আবার ডিপিপি অনুমোদন হলেও টেন্ডার প্রক্রিয়ায় দেখা দিচ্ছে নানা জটিলতা। একই প্রকল্পের টেন্ডার একাধিকবার করতে হচ্ছে। আবার কোনো প্রকল্পে টেন্ডার হলেও ভূমি অধিগ্রহণ করতে গিয়ে নানা জটিলতার সৃষ্টি হয়।
মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০০৬ সালে ঢাকার মোহাম্মদপুরে ৩০৫ কোটি ৫৯ লাখ টাকায় এক হাজার ২০টি ফ্ল্যাট নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। প্রকল্প বাস্তবায়নের মেয়াদ ছিল ২০১১ সালের জুন পর্যন্ত। তবে সঠিক সময়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। অজুহাত হিসেবে দেখানো হচ্ছে, ভূমি অধিগ্রহণের সময় পার্শ্ববর্তী এলাকার লোকজনের বাধা ও পাইলের আকৃতি পরিবর্তনের কারণে তা নির্দিষ্ট সময়ে করা সম্ভব হয়নি।
মূলত পাইলের ক্ষেত্রে পরিবর্তনের কারণেই এটি নির্দিষ্ট সময়ে বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। আর সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দুর্বল পর্যবেক্ষণ ও দায়িত্বহীনতার কারণে এটি বারবার পরিবর্তন করতে হয়েছে। এ সত্ত্বেও মন্ত্রণালয় থেকে প্রকল্পের মেয়াদ আরও দেড় বছর বাড়ানোর অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। ঢাকা শহরের চারদিকে চারটি উপশহর গড়ে তোলার লক্ষ্যে ২০১০ সালের শুরুর দিকে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিরা জায়গা নির্ধারণে বিভিন্ন এলাকা পরিদর্শন করেন। একই বছরের মাঝামাঝি সময়ে উপশহর প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। তবে ছয় বছর পার হলেও উপশহর প্রকল্পের ডিপিপি প্রস্তুত হয়নি। আদৌ এটি হবে কি-না, তা নিয়েও রয়েছে সংশয়। মন্ত্রণালয় থেকে বলা হচ্ছে, অনেক চিন্তাভাবনা করে ডিপিপি করা হচ্ছে। ক
ারণ, জনগণকে সঙ্গে নিয়ে এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে হবে।
উত্তরা আদর্শ আবাসিক শহর (তৃতীয় পর্ব) প্রকল্পে ২২ হাজার ফ্ল্যাট নির্মাণে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় একটি খসড়া ডিপিপি তৈরি করে। তবে সংসদীয় কমিটি এটি মেনে নেয়নি। ডিপিপিতে ফ্ল্যাটের যে মূল্য ধরা হয়েছে, তা বাস্তবসম্মত নয় বলে কমিটি উল্লেখ করে। পরে সংসদীয় কমিটি থেকে নতুন মূল্য নির্ধারণে একটি উপকমিটি তৈরি করে দেওয়া হয়। এই উপকমিটি ফ্ল্যাটের মূল্য নির্ধারণ করে প্রতিবেদন দেয়। তবে মন্ত্রণালয় তাদের রিপোর্টটি মেনে নিতে নারাজ ছিল। এতে কালক্ষেপণ হয়। পরে সমঝোতার মাধ্যমে ডিপিপি তৈরি করে পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হলে তা অনুমোদন পায়। প্রকল্পের কাজও শুরু হয়। প্রথম পর্যায়ে প্রায় ছয় হাজার ফ্ল্যাট হস্তান্তরের কথা রয়েছে। তবে নির্দিষ্ট সময়ে ফ্ল্যাট হস্তান্তর করা সম্ভব হবে না বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
ঢাকার মিরপুরে সরকারি ও আধা-সরকারি কর্মকর্তাদের আবাসনের জন্য জয়নগর আবাসিক প্রকল্পে ব্যয় ধরা হয়েছে ২০৬ কোটি ৯৭ লাখ টাকা। বাস্তবায়ন মেয়াদকাল ধরা হয় জুলাই ২০১০ থেকে ২০১৩ সালের জুন মাস পর্যন্ত। এখন পর্যন্ত এ প্রকল্পের কাজে কোনো অগ্রগতি নেই। এর ব্যয় আরও যৌক্তিক করার পরামর্শ দিয়েছে গৃহায়ন মন্ত্রণালয়। এখানে ১৪ তলাবিশিষ্ট ১৩টি ভবন নির্মাণ করা হবে। মোট ফ্ল্যাট হবে ৬৭৬টি।
২০১০ সালে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সামনে বিকল্প সড়ক নির্মাণের প্রকল্প গ্রহণ করে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়। এটি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার প্রকল্প ছিল। প্রকল্পের কাজ আগামী বছরের জুনে শেষ হওয়ার কথা। তবে এখন পর্যন্ত ডিপিপিই অনুমোদন করতে পারেনি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।
২০০৯ সালের জুলাইয়ে রাজধানীর ইন্দিরা রোড থেকে পান্থপথ সংযোগ সড়ক প্রশস্তকরণের প্রকল্প গ্রহণ করে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়। ২০১২ সালের জুন মাসে এ প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা। এ প্রকল্পের অগ্রগতি নেই।
২০১০ সালের জুলাইয়ে একনেক সভায় গুলশান-বনানী-বারিধারা লেক উন্নয়ন প্রকল্পের ডিপিপি অনুমোদন হয়। প্রকল্পের কাজ ২০১৩ সালের জুন মাসে শেষ হওয়ার কথা ছিল। প্রকল্পের কাজ শুরু হলেও তেমন অগ্রগতি নেই। প্রকল্পের ভূমি অধিগ্রহণে নানা জটিলতা দেখা দেয়। একটি স্বার্থান্বেষী মহল এতে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়। তারা কয়েকটি মামলাও করেছে সরকারের বিরুদ্ধে। এ জন্য কাজ শুরুতে দেরি হয়েছে।
৫১৭ কোটি টাকা ব্যয়ে বেগুনবাড়ী খালসহ হাতিরঝিল এলাকার সমন্বিত উন্নয়ন শীর্ষক প্রকল্পে ক্ষতিগ্রস্ত আবাসিক ভবন মালিকদের পুনর্বাসন ও বিক্রয়ের জন্য ১১২টি অ্যাপার্টমেন্ট নির্মাণ প্রকল্প, মাদানী এভিনিউর পূর্বমুখী সম্প্রসারণসহ অগ্রাধিকারমূলক কয়েকটি প্রকল্পও সঠিক সময়ে বাস্তবায়ন নিয়ে নানা প্রশ্ন রয়েছে। পাশাপাশি বিভিন্ন প্রকল্পের কাজ ত্বরান্বিত করতে কয়েকটি কর্তৃপক্ষ গঠনের যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তা আলোর মুখ দেখবে কি-না এ নিয়ে রয়েছে সংশয়।
এ ব্যাপারে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান আবদুর রহমান বলেন, আবাসন খাতকে শক্তিশালী করতে ভালো কয়েকটি প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। তবে প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নে নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হচ্ছে। হাজার চেষ্টা করেও প্রতিবন্ধকতা দূর করা যাচ্ছে না। কারণ, প্রতিবন্ধকতা যারা সৃষ্টি করছে, তারা অনেক শক্তিশালী। সমকাল