//বজ্রপাতে মৃত্যু//
ডেস্ক রিপোর্ট : প্রতি বছরই বর্ষার আগে কালবৈশাখী ঝড়ের সঙ্গে দেশে বজ্রপাতের ঘটনায় ব্যাপক প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। গত কয়েকদিনে বজ্রপাতে দেশের বিভিন্ন স্থানে শতাধিক মানুষের মৃত্যু হয়েছে। আবহাওয়া অধিদপ্তর বলছে, ঋতু পরিবর্তনের সময় বায়ু মন্ডলে এক ধরনের অস্থিরতার সৃষ্টি হয়। এ সময়ে বায়ুমন্ডলে বাতাসের তাপমাত্রা ভূ-ভাগের উপরিভাগের তুলনায় কম থাকে। এ অবস্থায় জলীয় বাষ্প ও মেঘের কনার মধ্যে এক ধরনের ঘর্ষণের ফলে ধনাত্মক ও ঋণাত্মক আয়নের সৃষ্টি হয়। এর ফলে ওই এলাকার উপর বজ্রমেঘ সৃষ্টি হতে থাকে। এটি যখন তীব্র আকার ধারণ করে তখন এটি নীচে চলে আসায় বজ্রপাতের ঘটনা ঘটে। আবহাওয়া অধিদপ্তর মনে করে, মার্চ থেকে মে এবং অক্টোবর থেকে নভেম্বরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বজ ঝড় হয়ে থাকে। আর জনসংখ্যার ঘনত্ব বেশি হওয়ার কারণেই বজ্রপাতে এখন বাংলাদেশে প্রাণহানির সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা জানান, পৃথিবীর অন্যসব দেশের তুলনায় বজ পাতে মৃত্যুর সংখ্যা বাংলাদেশেই বেশি। বিশ্বের বজ পাতে মৃত্যুর এক-চতুর্থাংশ ঘটে বাংলাদেশে। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল লাইটনিং সেফটি ইনস্টিটিউটের ২০১০ সালে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ পরিসংখ্যান উল্লেখ করা হয়েছে। এদিকে বজ পাতের সময় কিছু সতর্কতা অবলম্বন করলে হতাহতের ঘটনা এড়ানো যায়।
দুর্যোগ-ব্যবস্থাপনা সংশ্লিষ্ট গবেষকেরা বলেছেন, বড় গাছের অভাব বজ পাতে মৃত্যুর একটা কারণ হতে পারে। অন্যদিকে শহরাঞ্চলে ঘরবাড়ি বেশি হলেও সেখানে বজ নিরোধক থাকায় বজ পাতের ঘটনা কম। কিন্তু গ্রামের এই নিরোধক হিসেবে কাজ করতো যে বড় গাছ, তার সংখ্যা হ্রাস পেয়েছে। আর এতেই বাড়ছে প্রাণহানি। এছাড়া গ্রামে খোলা জায়গা থাকায় বজ্রপাত বেশি হচ্ছে।
বিলুপ্ত সার্ক আবহাওয়া গবেষণা কেন্দ্রের সাবেক পরিচালক সুজিত কুমার দেবশর্মা সাংবাদিকদের বলেন, কালবৈশাখীর মৌসুমে বজ ঝড় বেশি হয়। বাংলাদেশে প্রতি বছর বজ পাতে গড়ে দুই থেকে তিনশ মানুষের প্রাণহানি ঘটে। তিনি বলেন, যখন কিউমুলোনিম্বাস মেঘ তৈরি হয়, তখনই বজ ঝড় হয়ে থাকে। কিউমুলোনিম্বাস মেঘ হচ্ছে খাড়াভাবে সৃষ্টি হওয়া বিশাল আকৃতির পরিচালন মেঘ; যা থেকে শুধু বিদ্যুৎ চমকানো নয়, বজ পাত-ভারি বর্ষণ-শিলাবৃষ্টি-দমকা-ঝড়ো হাওয়া এমনকি টর্নেডোও সৃষ্টি হতে পারে। তিনি বলেন, বায়ুমন্ডলে বাতাসের তাপমাত্রা ভূ-ভাগের উপরিভাগের তুলনায় কম থাকে। এ অবস্থায় বেশ গরম আবহাওয়া দ্রুত উপরে উঠে গেলে আর্দ্র বায়ুর সংস্পর্শ পায়। তখন গরম আবহাওয়া দ্রুত ঠান্ডা হওয়ায় প্রক্রিয়ার মধ্যে আলোড়ন সৃষ্টি হয়ে বজ মেঘের সৃষ্টি হয়।
বজ্রপাত থেকে রক্ষার উপায়
বজ পাতের সময় পাকা বাড়ির নিচে আশ্রয় নিতে এবং উঁচু গাছপালা বা বিদ্যুতের লাইন থেকে দূরে থাকার পরামর্শ দিয়েছেন আবহাওয়া বিশেষজ্ঞরা। এ সময় জানালা থেকে দূরে থাকার পাশাপাশি ধাতব বস্তু এড়িয়ে চলা, টিভি-ফ্রিজ না ধরা, গাড়ির ভেতর অবস্থান না করা এবং খালি পায়ে না থাকারও কথা বলা হয়েছে।
আবহাওয়া বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ঘন ঘন বজ পাত হতে থাকলে খোলা বা উঁচু জায়গায় না থাকাই ভালো। সবচেয়ে ভালো হয় যদি কোনো দালানের নীচে আশ্রয় নেয়া যায়। বজ পাত হলে উঁচু গাছপালা বা বিদ্যুতের খুঁটিতে বিদ্যুৎস্পর্শের সম্ভাবনা বেশি থাকে। তাই বজ ঝড়ের সময় গাছ বা খুঁটির কাছাকাছি থাকা নিরাপদ নয়। ফাঁকা জায়গায় যাত্রী ছাউনি বা বড় গাছে বজ পাত হওয়ার আশঙ্কা থাকে অত্যন্ত বেশি। বজ পাতের সময় বাড়িতে থাকলে জানালার কাছে গিয়ে উঁকিঝুঁকি নিরাপদ নাও হতে পারে। এ সময় জানালা বন্ধ রেখে ঘরের ভেতরে থাকার পরামর্শ দেয়া হয়েছে।
বজ পাত ও ঝড়ের সময় বাড়ির ধাতব কল, সিঁড়ির রেলিং, পাইপ ইত্যাদি স্পর্শ করা ঠিক হবে না। এমনকি ল্যান্ড ফোন ব্যবহার না করতেও পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। বজ পাতের সময় এগ
ুলোর সংস্পর্শ এসে অনেকে স্পৃষ্ট হন। বজ পাতের সময় বৈদ্যুতিক সংযোগযুক্ত সব ধরনের যন্ত্রপাতি এড়িয়ে চলা উচিত। টিভি, ফ্রিজ ইত্যাদি বন্ধ করা থাকলেও স্পর্শ করা ঠিক হবে না। বজ পাতের আভাস পেলে আগেই প্লাগ খুলে রাখা ভালো। বজ পাতের সময় রাস্তায় গাড়িতে থাকলে যত দ্রুত সম্ভব বাড়িতে ফেরার চেষ্টা করতে হবে। যদি তখন প্রচ- বজ পাত ও বৃষ্টি হয়, তাহলে গাড়ি কোনো পাকা ছাউনির নীচে রাখা যেতে পারে। ওই সময় গাড়ির কাচে হাত দেওয়াও বিপজ্জনক হতে পারে। বৃষ্টি হলে রাস্তায় পানি জমতে পারে। অনেক সময় বিদ্যুতের তার ছিঁড়ে সেই পানিতে পড়ে হতে পারে দুর্ঘটনার কারণ। কাছে কোথাও বাজ পড়লেও সেই পানি হয়ে উঠতে পারে বিদ্যুৎস্পৃষ্টের কারণ। বজ পাতের সময় চামড়ার ভেজা জুতা বা খালি পায়ে থাকা খুবই বিপজ্জনক। যদি একান্ত বের হতেই হয়, পা ঢাকা শুকনো জুতো ব্যবহার করা ভালো। রাবারের গামবুট এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে ভালো কাজ করবে।
আবহাওয়া বিশেষজ্ঞরা জানান, খোলা জায়গায় আকাশে বিদ্যুৎ চমকানো শুরু হলে মুঠোফোন বন্ধ করে দিতে হবে। মাথার ওপর ছাতা মেলে রাখলে তাও গুঁটিয়ে নিতে হবে। ধাতব পদার্থের মাধ্যমে বৈদ্যুতিক চার্জ শরীরে প্রবাহিত হতে পারে এমন আশঙ্কায় সতর্কতামূলক এই ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। আর ফোন বা ছাতা বন্ধ করার আগেই যদি কাউকে বজ পাত আঘাত করে, তবে সঙ্গে সঙ্গে তাকে কাছের কোনো হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া জরুরি।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বজ পাতের ঘটনা খোলা প্রান্তরে বেশি দেখা যায়। বর্তমানে কৃষিশ্রমিকের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। এটি মৃত্যুর সংখ্যা বৃদ্ধির একটা কারণ হতে পারে। এ ছাড়া আগে কৃষিতে ধাতব যন্ত্রপাতির ব্যবহার ছিল না বললেই চলে। কৃষকের কাছে বড়জোর কাস্তে থাকত। কিন্তু এখন ট্রাক্টরসহ নানা কৃষি যন্ত্রাংশ বা মুঠোফোনের মতো ধাতব যন্ত্রপাতির ব্যবহার বেড়ে গেছে। এসব ধাতব বস্তুর ব্যবহার বজ পাতে ক্ষতির আশঙ্কা তৈরি করছে। ইত্তেফাক