রিকু আমির : বাংলাদেশের চিকিৎসার মানের দিকে জোর নজর দেয়া উচিৎ বলে মন্তব্য করেছেন প্রধানমন্ত্রীর সাবেক সমাজ কল্যাণ ও স্বাস্থ্য, পরিবার কল্যাণ উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. সৈয়দ মোদাচ্ছের আলী।
রোববার সকালে আমাদের সময় ডটকম ও আমাদের অর্থনীতি কার্যালয়ে আয়োজিত নিয়মিত বৈঠকে তিনি এ মন্তব্য করেন।
তিনি বলেন, এদিকে নজর দেয়ার কথা বলার কারণ, মানুষ এখনও চিকিৎসকের উপর অনেক ভরসা করে, সেই ভরসার জায়গায় যদি আমাদের চিকিৎসাটা সঠিক না হয়, তবে এর চেয়ে বড় অন্যায় আর হতে পারে না। নিজের কাছে জাতির কাছে আমরা দায়ী হব।
চিকিৎসার মানের জন্য কিছু খরচ হবেই উল্লেখ করে মোদাচ্ছের আলী বলেন, সে খরচের বিষয়ে রাষ্ট্রের দায়িত্ব থাকে। সরকারি প্রতিষ্ঠান বা মেডিকেল কলেজগুলি কম খরচে সেবা দেবে। প্রাইভেট সেক্টরগুলোতে আমি আনলিমিটেড আকারে বা অযৌক্তিকভাবে খরচ কমানোর পক্ষপাতি না। আমি চাই- চিকিৎসায় সামান্যতম যদি কোনো গাফিলতি হয়, এটা যে কোনো ভাবেই হোক, এ বিষয়ে কঠোর শাস্তি দেয়া দরকার। যাতে এটা রিপিট না হয়। বিশ্বের অনেক দেশে এ প্রচলন আছে। চিকিৎসকরা যদি কমিশন খাওয়া বন্ধ করতে হবে। এটা চিকিৎসায় ব্যয়ভার কমাবে বলে মনে করেন তিনি।
কোনো চিকিৎসক ঠিকভাবে পড়ান না- এমন বিষয়ে গত ৫০ বছরে কয়টা লেখা ছাপা হয়েছে পত্রিকায়, আমার নজরে পড়েনি উল্লেখ করে মোদাচ্ছের আলী বলেন, লেখা হয়, রাত ২টায় অমুক এসেছিলেন হাসপাতালে, তার ঠিক মতো চিকিৎসা হয়নি, মেডিকেল কলেজের প্রফেসরকে পাওয়া যায়নি। যারা এসব লেখেন, তারা ভুলে যান, মেডিকেল কলেজের প্রফেসর কাম কনসালটেন্ট হাসপাতালের ডিউটি তার সেকেন্ডারি। তার মূল দায়িত্ব কলেজে ছাত্রছাত্রী পড়ানো। এ ব্যাপরে কিন্তু কোনো পুরষ্কারও নেই, শাস্তিও নেই। পাবলিক দ্বারা নেই, মিডিয়া ও সরকার দ্বারাও নেই। একজন ভাল প্রফেসরের ডেফিনেশন আমাদের দেশে, আপনি রোগী দেখাতে গিয়ে কত সময় আমার জন্য গিয়ে বসে থাকেন। রোগী দেখা বা দেখিয়ে দেয়ার জন্য তদবির আসে। কিন্তু ক্লাসের বিষয়ে কোনো তদবির আসে না।
‘‘বেসরকারিখাতে যে মেডিকেল কলেজগুলো গড়ে উঠেছে, সে কলেজগুলোর মান নিয়ে মিডিয়া প্রায় সময় লেখে। লেখাগুলো উদ্দেশমূলক। এ লেখা কেউ কোনোদিন চ্যালেঞ্জ করেনি। এটা আমার কাছে খুব অবাক লাগে। কারণ চ্যালেঞ্জ করার মতো জায়গা নেই কর্তৃপক্ষের।’’
দেশের মেডিকেল শিক্ষা ব্যবস্থা সম্পর্কে চক্ষু বিশেষজ্ঞ মোদাচ্ছের আলী বলেন, অন্য অভাবের মাঝেও আমাদের দেশে বেসিক সায়েন্স, ফিজিওলজি, এনাটমির চিকিৎসক অভাব। এজন্য অনেক মেডিকেল কলেজ বিদেশ থেকে শিক্ষক নিয়ে আসেন। সেটা হোক আইন অমান্য করে বা ব্যবসায়ীক উদ্দেশে। বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলোকেও এসব করতে হবে। কোন প্রাইভেট মেডিকেল পোস্ট মর্টেম কার্যক্রম সঠিকভাবে চালাচ্ছে। কোনো না কোনো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তাদের সমঝোতা থাকে। এতে আমাদের মেডিকেল শিক্ষায় শূন্যতা থেকেই যাচ্ছে।
‘‘সরকার একের পর এক মেডিকেল কলেজ করছে, অনুমোদন দিচ্ছে বেসরকারি মেডিকেল কলেজের। আবার হচ্ছে মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ও। আসলে মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সঠিক সংজ্ঞা কী, সেটাও দেখার বিষয়। বিশ্ববিদ্যালয় বলতে যদি এই হয়- শুধুমাত্র এমবিবিএস বা নার্সিং বিষয়ে পড়াশোনা করার, ডিগ্রি দেয়া। তবে তো বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো দরকার নেই। বিশ্ববিদ্যালয় তার গবেষণা করল কি-না, শিক্ষা পদ্ধতি উন্নত, যুগোপযোগী করল কি-না, রোগী উপযোগী শিক্ষা দিল কি-না- এসব প্রধান বিষয়। আমাদের দেশে যতো রোগী পাওয়া যায়, বিশ্বের কোথাও এতো রোগী পাওয়া যায় না। কিন্তু সেই রোগীগুলোর প্রতি যদি আমরা সিনিয়ররা যতœবান না হই, তবে জুনিয়ররা তো শিখবে না। আমি যদি রোগ নির্ণয় করার আগে চার-পাঁচটা ওষুধ লিখে দিই। তাহলে তো জুনিয়রাও তা-ই করবে, তখন ওষুধ কোম্পানিগুলো সে সুযোগ গ্রহণ
ের চেষ্টা করবে।’’
গণমাধ্যমের দৃষ্টি আকর্ষণ করে তিনি বলেন, মিডিয়ার অটোমেটিক কিছু দায়িত্ব আছে। যেমন চিকিৎসকের দায়িত্ব চিকিৎসা দেয়া। কেউ দায়িত্ব প্রদান করুক আর নাই-বা করুক। আপনি যখন এ পেশায় এসেছেন, আপনার উপর দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে- আপনি চিকিৎসা দেবেন। আপনি যা লেখবেন, তার গভীরে যাবেন, উদ্দেশ্য নিয়ে লিখবেন, সেখানে কোনো খাতির করবেন না।
কমিউনিটি ক্লিনিকের উপর খুব জোর দিয়ে যদি প্রাইমারি করা যায় এবং তার রেফারাল সিস্টেমের উন্নয়ন ঘটানো যায় তবে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্য সেবা প্রাপ্তি অনেক উন্নত হবে মন্তব্য করে সৈয়দ মোদাচ্ছের আলী বলেন, উপজেলা হাসপাতাল থেকে কমিউনিটি ক্লিনিকের দূরত্ব অনেক জায়গায় অনেক বেশি হয়। যেমন- কারও আঙুল কেটে গেলে তাতে সেলাই দেয়ার ব্যবস্থা কমিউনিটি ক্লিনিকে নেই। এর জন্য যদি পনের-ষোল মাইল যেতে হয়। ওই রোগীর সঙ্গে আরেকজনেরও যেতে হবে। এতে উভয়েরই আর্থিক ক্ষতি। এজন্য কী করা যাবে? অনেক জায়গায় মেডিকেল সেন্টার আছে, ফ্যামিলি প্ল্যানিং এর। এসব স্থানে কমিউনিটি ক্লিনিকের মতো প্রজেক্ট করে, সাব-সেন্টার বা ১০ শয্যার হাসপাতাল করা যেতে পারে। এটা করলে গরিব লোকের মৌলিক চিকিৎসা চাহিদা পূরণ হবে, উন্নতি হবে। রেফারাল সিস্টেমও উন্নত হবে। এরপর উপজেলা পর্যায়ের হাসপাতালগুলোয় বিশেষ চিকিৎসা যেমন কিডনি ট্রান্সপ্লান্টসহ আরও কিছু বিষয় ছাড়া চিকিৎসা ব্যবস্থা চালু করতে হবে। তবেই আমরা বিশ্বে মডেল হতে পারব। ঢাকায় রোগীর ভীড়ও কমে যাবে।
‘‘আমাদের যে ইন্টার্নি করা হয় এক বছর মেয়াদি, এটা দুই বছর করা যেতে পারে। এক বছর হাসপাতালে আরেক বছর গ্রামে। এটা গ্রামে থেকে কাজ করার অনুপ্রেরণা যোগাবে।’’
বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা তুলনা করতে দিয়ে মোদাচ্ছের আলী বলেন, আমাদের উচ্চ চিকিৎসা ব্যবস্থা এডহক ভিত্তিতে চলছে। যে রোগের চিকিৎসা ব্যবস্থা করলে টাকা বেশি উপার্জন করা যাবে, সেদিকে যাওয়া হচ্ছে। এখন প্রমাণিত অনেক বিষয়ে আমরা ব্যাংকক, সিঙ্গাপুর থেকে নিচে আছি। যেমন- দেশে যে ক্যান্সার রোগীকে বলা হয়, আপনি তিন-চার মাস বাঁচবেন, সে রোগী ওইসব দেশে চিকিৎসা নিয়ে দীর্ঘ দিন বেঁচে থাকেন।
‘‘ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে কিন্তু কোনো রোগী কলকাতা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গেছে, গত ৫০ বছরে এমন রেকর্ড নেই। কলকাতা মেডিকেল ঢাকা মেডিকেলের চেয়ে বেশি উন্নত না। কিন্তু সেখানকার প্রাইভেট সেক্টর অনেক এগিয়েছে। আমি মনে করি ঢাকার চেয়ে কলকাতা মেডিকেলে অন্ততঃ উপরে আছে, একসেপ্ট ক্যান্সার। সমগ্র ভারতের কথা বললে প্রথমেই বলতে হয়, দক্ষিণ অংশের কথা। দক্ষিণ ভারতের চিকিৎসা ব্যবস্থা, মান বিশ্বের যে কোনো উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থার সঙ্গে তুলনীয় । গুজরাটের চিকিৎসা ব্যবস্থাও উন্নত।’’
দেশের মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমাদের মেডিকেল শিক্ষায় ভর্তি পরীক্ষার বিষয়টি এখনও সৎ ভাবে হচ্ছে। কিন্তু ফেয়ার কি-না, সন্দেহ আছে। কারণ আমরা যে মেথডে ভর্তি পরীক্ষা নিই, এ মেথডেই সবচেয়ে ভাল ডাক্তার হবে, এ বিষয়ে সবার অংশগ্রহণে ডিবেট প্রয়োজন আছে।
‘‘সবাই জানে ফিজিওথেরাপি খুব দরকারি। কিন্তু আমাদের দেশে প্রপারলি ফিজিওথেরাপি উন্নত করার জন্যে কোনো আলোচনা নেই, ব্যবস্থাপনাও নেই। জিপিএ কত পেলে ফিজিওথেরাপি পড়তে পারবে, এটা এখনও আনডিসাইডেট।’’