আরিফুর রহমান: জলবায়ু পরিবর্তন নয়, গঙ্গার পানির প্রবাহ কমে যাওয়াতেই, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের লবণাক্ততা বেড়েছে। মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট ও যৌথ নদী কমিশনের তথ্য বিশ্লেষণ করে, এই তথ্য মিলেছে।
তবে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে, আগামী কয়েক দশকে, এই সমস্যা আরও ভয়াবহ রূপ নেবে। এদিকে, ভারতের সাথে গঙ্গা চুক্তির মেয়াদ আছে আর দশ বছর। তাই, গঙ্গার পানির ন্যায্য হিস্যা আদায়ে, এখন থেকেই আলোচনা শুরুর পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
হিমালয় দুহিতা গঙ্গা। আড়াই হাজার কিলোমিটার পথ পরিক্রমায় উত্তর ভারতের ৫টি রাজ্য ঘুরে চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী সীমান্ত হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। যে নদীর ওপর নির্ভরশীল বাংলাদেশের এক তৃতীয়াংশ এলাকা।
হাজার বছরে পানি প্রবাহে প্রথম বাঁধা আসে ৪ দশক আগে ফারাক্কা ব্যারেজ নির্মাণের পর। গঙ্গার পানি সরিয়ে নিতে শুরু করে ভারত। শুষ্ক মৌসুমে মিঠা পানির সংকট শুরু হয় বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে। বেড়ে যায় লবণাক্ততা।
১৯৭৩ সালে উপকূলের ৮ লাখ ৩৩ হাজার ৪৫০ হেক্টর জমি লবণাক্ত ছিল। ২০০০ সালে ১০ লাখ ২০ হাজার ৭৫০ হেক্টর। আর ২০০৯ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১০ লাখ ৫৬ হাজার ২শ’ ৬০ হেক্টর। অর্থাৎ চার দশকে জমির লবণাক্ততা বেড়েছে প্রায় ২৭ ভাগ।
১৯৯০ থেকে ৯৬ সালের মধ্যে শুষ্ক মৌসুমে খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাঘেরহাটের নদীগুলোতে লবণাক্ততা বেড়ে যায় আশঙ্কাজনকভাবে। ১৯৯৬ সালে গঙ্গা চুক্তি পর পানি প্রবাহ বাড়লে লবণাক্ততা কিছুটা কমে যায়। এরপর থেকে লবণাক্ততার মাত্রা কিছুটা ওঠানামা করেছে গঙ্গার পানি প্রবাহের তারতম্যের ওপর। মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট ও যৌথ নদী কমিশনের তথ্য বিশ্লেষণ করলেই তার প্রমাণ মেলে। অথচ অনেকেই এই অঞ্চলের লবণাক্ততাকে জলবায়ু পরিবর্তনের ফল হিসাবে চালিয়ে দিতে চান।
আইপিসিসির সদস্য আহসান উদ্দীন আহমেদ বলেন, ‘এ যাবৎকালে যা দেখেছি সেই লবণাক্ততা জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য নয়। এটি মূলত ফারাক্কা থেকে উজানে পানি প্রত্যাহারের কারণে। এই পরিবর্তনের সূচনা হয়েছে ৭৫ এর পর থেকে ফারাক্কা যখন আস্তে আস্তে পানি সরিয়ে নেয়ার চেষ্টা করেছ এবং তার তীব্রতম অবস্থাটা ছিল ৯০ থেকে ৯৬ সালে। কিন্তু ৯৬ সালের ডিসেম্বরে গঙ্গা পানি বন্টন চুক্তি হওয়ার পর থেকে আবার কিছুটা লবণাক্ততা কমেছে। ৯০ থেকে ৯৬ সালের মধ্যে যখন লবণ পানি ভেতরে ঢুকে গিয়েছিল তখন লবণ পানি মিষ্টি পানি যেখানে মেশে সেখানে পলির পরিমাণ অনেক বেড়ে যায়। ফলে সুইজগেটের বাইরে নদীর বুকে এমন পরিমাণ পলি জমে গিয়েছিল যে পলিটা তাৎক্ষণিকভাবে সরানোর চিন্তা করা হয়নি। যতদিনে পলি মাটি সরানোর চিন্তা করা হয়েছে ততদিসে ৯০ ভাগ সুইজগেট বন্ধ হয়ে গেছে। আর স্থানীয়রা লবণ পানি ঢুকানোর স্বার্থে সুইজগেটগুলোকে সংস্কারের কোন ব্যবস্থা নেয়াই যায়নি। ভারতের সাথে গঙ্গা চুক্তি করে তৃপ্তি নিয়ে ঘুম দেওয়ারমত অবস্থা। তারপর প্রায় ২০ বছর যায় যায়। আমরা দেখেছি তিস্তা চুক্তি নিয়ে দীর্ঘদিন আলোচনা হচ্ছে কোন কাজ কাজ হচ্ছে না। গঙ্গা চুক্তি নিয়ে এরপরে যদি আলোচনা শুরু করি তাহলে ২০২৬ সালের পরে পানি পাব কিনা সেটা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে’।
খুলনার এসআরডিআইয়ের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা শচীন্দ্র নাথ বিশ্বাস বলেন, যখন দেখি ওপর থেকে পানির প্রবাহ কম হয় তখন লবণাক্ততা বেড়ে যায় এবং সমুদ্রের পানি ভেতরের দিকে আসতে থাকে।
গঙ্গার পানির ওপর নির্ভরশীল দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের নদ-নদীগুলো মরে গেছে। গড়াই নদীতে শুষ্ক মৌসুমে পানিই ঢোকে না। অন্য নদীগুলো পলি পরে ভরে গেছে। উজান থেকে পানি আসে না। তাই ভাটি থেকে জোয়ারের নোনা পানি উজানে চলে আসে। অন্যদিকে এই অঞ্চলের পানি ব্যবস্থাপনার কোন মা-বাপ নেই। ষাটের দশক থেকে শুরু করে যে ১২৭ টি পোল্ডার তৈরি করা হয়েছে তার
অধিকাংশই অকেজো হয়ে গেছে।
চিংড়ি চাষের কারণেও অনেক জমি লবণাক্ত হয়েছে। সবমিলিয়ে এই অঞ্চলে লবণাক্ততার যে সমস্যা পুরোটাই মানুষের তৈরি।
মূলত গঙ্গার পানির প্রবাহ কমে যাওয়া এবং এর শাখানদীগুলো অচল হয়ে পড়ায় এই অঞ্চলের লবণাক্ততা বেড়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে এই লবণাক্ততা আরও বেড়ে যাবে। তাই সংকট মোকাবেলায় ভারতের কাছ থেকে গঙ্গার পানির ন্যায্য হিস্যা আদায়ের কোন বিকল্প নেই। সূত্র: চ্যানেল ২৪ থেকে নেয়া.