সালমা পারভীন : আজ ১৬ মে ঐতিহাসিক ফারাক্কা লং মার্চ দিবস। ১৯৭৬ সালের এই দিনে মজলুম জননেতা মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে মরণ বাঁধ ফারাক্কা অভিমুখে লাখো জনতার লং মার্চ অনুষ্ঠিত হয়। যার রেশ উপমহাদেশ ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও পৌঁছে যায়। আজো এই দিনটি ভারতীয় আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে দাবি আদায়ের পক্ষে প্রেরণার উৎস হয়ে আছে। ফারাক্কা লং মার্চের ৪০তম বার্ষিকী উপলক্ষে রাজশাহীর পদ্মাপাড়ে আজ এক গণজমায়েতের আয়োজন করা হয়েছে।
এদিকে ফারাক্কা চুক্তির নামে ভারতের পানি-প্রতারণাও অব্যাহত রয়েছে। ১৯৯৬ সালে ৩০ বছর মেয়াদি গঙ্গা চুক্তি স্বাক্ষরের পর এবছর এই প্রথম বাংলাদেশ সর্বনিম্ন পানি পেয়েছে। শুষ্ক মৌসুমে ফারাক্কা বাঁধ পেরিয়ে এতো কম পানি আর কখনই বাংলাদেশের ভাগ্যে জোটেনি। এমনকি গঙ্গা চুক্তি যখন ছিল না সেই সময়টাতে পানি নিয়ে এমন দুর্ভোগের মুখে পড়তে হয়নি বাংলাদেশকে। পানি না পাবার প্রধান কারণ, উৎস থেকে শুরু করে গঙ্গার মাঝপথেই পানির সিংহভাগ প্রবাহ সরিয়ে নিচ্ছে ভারত। ফলে পর্যাপ্ত পানি ফারাক্কা পর্যন্ত পৌঁছাতে পারছে না। সে কারণে ফারাক্কা পয়েন্টে বাংলাদেশকে দেবার মতো যথেষ্ট পানি থাকে না। মধ্যখানে বাংলাদেশের মানুষ চুক্তির নামে প্রতারণার শিকার হচ্ছে বলে পর্যবেক্ষকদের অভিমত।
উল্লেখ্য, মওলানা ভাসানীর সেদিনের লং মার্চ ছিল বাংলাদেশে ভারতের পানি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লাখো জনতার এক বজ্রনির্ঘোষ প্রতিবাদ যা দিল্লীর মসনদেও কাঁপন ধরিয়ে দেয়। ওই দিন রাজশাহীর মাদরাসা ময়দান থেকে লং মার্চ শুরু হয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জের কানসাটে গিয়ে শেষ হয়। দিনটি ছিল রোববার। সকাল ১০টায় রাজশাহী থেকে শুরু হয় জনতার পদযাত্রা। হাতে ব্যানার আর ফেস্টুন নিয়ে অসংখ্য প্রতিবাদী মানুষের ঢল নামে রাজশাহীর রাজপথে। ভারতবিরোধী নানা শ্লোগানে মুখরিত হয়ে উঠে পুরো জনপদ। বেলা ২টায় লাখো মানুষের গোদাগাড়ীর প্রেমতলী গ্রামে গিয়ে পৌঁছায়। সেখানে মধ্যাহ্ন বিরতির পর আবার যাত্রা শুরু হয়। সন্ধ্যা ৬টায় লং মার্চ চাঁপাইনবাবগঞ্জ কলেজ মাঠে পৌঁছায়। কলেজ মাঠেই রাত যাপনের পর সোমবার সকাল ৮টায় আবার যাত্রা শুরু হয় শিবগঞ্জের কানসাট অভিমুখে। ভারতীয় সীমান্তের অদূরে কানসাটে পৌঁছানোর আগে মহানন্দা নদী পার হতে হয়। লাখ লাখ মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে যোগ দেন এই লং মার্চে। তারা নিজেরাই নৌকা দিয়ে কৃত্রিম সেতু তৈরি করে মহানন্দা নদী পার হন। কানসাট হাইস্কুল মাঠে পৌঁছানোর পর সমবেত জনতার উদ্দেশে মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী তার জ্বালাময়ী ভাষণ দেন। মওলানা ভাসানী ভারতের উদ্দেশে বলেন, ‘তাদের জানা উচিত বাংলার মানুষ এক আল্লাহকে ছাড়া আর কাউকে ভয় পায় না। কারো হুমকিকে পরোয়া করে না।’ তিনি বলেন, ‘আজ রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও কানসাটে যে ইতিহাস শুরু হয়েছে তা অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর নতুন অধ্যায়ের সৃষ্টি করবে।’ মওলানা ভাসানী এখানেই লংমার্চের সমাপ্তি ঘোষণা করেন। বাংলাদেশ সীমানার মধ্যে লং মার্চ সমাপ্ত হলেও সে দিন জনতার ভয়ে ভীত ভারতীয়রা সীমান্তে প্রচুর সৈন্য মোতায়েন ও নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করে। ১৯৭৬ সালে মওলানা ভাসানীর ঐতিহাসিক প্রতিবাদ পদযাত্রা গোটা জাতির চেতনাকে শাণিত করে। একদিকে জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে সরকার যখন ভারতের সঙ্গে ফারাক্কা সমস্যা নিয়ে দর কষাকষি করছিল, তখন মওলানা ভাসানীর এই পদযাত্রা সরকারের দর কষাকষিতে প্রবল শক্তি সঞ্চয় করে। সরকার সাহসী হয় ফারাক্কা সমস্যা জোটনিরপেক্ষ সম্মেলন ও জাতিসংঘে উত্থাপন করতে।
এদিকে চলতি বছরের শুকনো মওসুমের শুরুতেই বাংলাদেশে পদ্মা নদীতে চরের বিস্তার ঘটে চলেছে। সেই সঙ্গে পদ্মার শাখা-প্রশাখাসহ অন্তত ৩৬টি নদী কার্যত মৃত খালের রূপ নিয়েছে। এবার শুক
নো মৌসুম শুরুর আগেই গঙ্গায় পানির সংকটের প্রভাবে বাংলাদেশের পদ্মা শুকিয়ে মরা গাঙ্গে পরিণত হতে শুরু করেছে। এখনই পদ্মার বুক চিরে চলাচল করতে শুরু করেছে বালুবাহি ট্রাক, চাষাবাদও শুরু হয়েছে অনেক স্থানে।
এদিকে, ফারাক্কা চুক্তি অনুযায়ী প্রতিবছরের মতো এবারেও ১ জানুয়ারি থেকে শুরু হয়েছে শুকনো মৌসুম। ভারতের সাথে চুক্তি মোতাবেক এই শুষ্ক মওসুমের ৩১ মে পর্যন্ত উভয় দেশ দশদিনওয়ারি ভিত্তিতে গঙ্গার পানি ভাগাভাগি করে নেবার কথা। কিন্তু ভারতের পক্ষ থেকে কখনই এই সিডিউল মানা হয় না। সরকারের একজন কর্তাব্যক্তি স্বীকার করেন, চুক্তির ইন্ডিকেটিভ সিডিউল অনুযায়ী অনেক সময় পানি পাওয়া যায় না- এটা ঠিক। এ বিষয়টি ভারতকে জানানো হয়েছে এবং চুক্তি যথাযথভাবে মেনে চলার তাগিদ দেয়া হয়েছে। কিন্তু গঙ্গার ফারাক্কা পয়েন্টে পানি প্রবাহ আদৌ না থাকলে কীভাবে সিডিউল ঠিক থাকবে- তা জানা যায়নি। বিশেষজ্ঞদের হিসাবমতে ফারাক্কা চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশ গত পাঁচ বছরে ২০ ভাগ-এর কম পানি পেয়েছে। দেশের পানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গত ২১ থেকে ৩১ মার্চ ওই ১০ দিনে ভারত বাংলাদেশকে ১৫ হাজার ৬০৬ কিউসেক পানি দিয়েছে। যা ছিল স্মরণকালের সর্বনিম্ন পানির রেকর্ড। ১৯৯৬ সালে স্বাক্ষরিত ৩০ বছর মেয়াদি গঙ্গার পানি চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশ কেন এতো কম পানি পেল, এ নিয়ে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয় কিম্বা যৌথ নদী কমিশনের পক্ষ থেকে কোনো প্রতিবাদ জানানো হয়নি। ভারতের কাছে আপত্তি তোলা হয়নি- কেন বাংলাদেশকে এই শুষ্ক মৌসুমে ধারাবাহিকভাবে কম পানি দেয়া হলো। যৌথ নদী কমিশনের (জেআরসি) তথ্যানুযায়ী, ইতোপূর্বে ২০০৮ সালে ১১ থেকে ২০ এপ্রিল পর্যন্ত ওই ১০ দিনে ফারাক্কা পয়েন্ট দিয়ে বাংলাদেশের সর্বনিম্ন পানি পাওয়ার রেকর্ড ছিল ১৭ হাজার ৫১৯ কিউসেক। চলতি শুষ্ক মৌসুমে চুক্তি মোতাবেক বাংলাদেশ মাত্র ৪ বার ৩৫ হাজার কিউসেক করে গঙ্গার পানি পেয়েছে। এছাড়া ১ জানুয়ারি থেকে ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত ১০ দিনওয়ারি হিসাবে প্রতিটিতে বাংলাদেশ পানির ন্যায্য হিস্যা থেকে বঞ্চিত হয়েছে।
প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, গঙ্গার উৎস থেকে ফারাক্কা পর্যন্ত বহু বাঁধ আর খালের মাধ্যমে গঙ্গার পানি প্রত্যাহার করে চলেছে ভারত। শুধু ফারাক্কা বাঁধ নয়, কানপুরের গঙ্গা ব্যারাজ ও হরিদুয়ারে গঙ্গার পানি প্রত্যাহারে নির্মিত কৃত্রিম খালসহ অসংখ্য স্থাপনা নির্মাণ করেছে তারা। এখানেই শেষ নয়, ভারত ফারাক্কার উজানে উত্তর প্রদেশ রাজ্যের কানপুরে গঙ্গার ওপর আর একটি বাঁধ নির্মাণ করছে। এতে ব্যয় হচ্ছে প্রায় সাড়ে ৯শ’ কোটি রূপী। এছাড়া উত্তর প্রদেশ ও বিহারে সেচের জন্য প্রায় চারশত পয়েন্ট থেকে পানি সরিয়ে নেয়া হচ্ছে। এসব পয়েন্ট থেকে হাজার হাজার কিউসেক পানি প্রত্যাহার করা হচ্ছে। পরিণতিতে ফারাক্কা পয়েন্টে পানির প্রবাহ যে কমে যাবে তা পানির মতোই পরিষ্কার। ফলে বাংলাদেশের হাজারো চিৎকার আর আহাজারি সত্ত্বেও ফারাক্কা পয়েন্টে পানি না থাকার ফলে বাংলাদেশ তার ‘নায্য হিস্যা’ দূরে থাক সাধারণ চাহিদাটুকুও পূরণ করতে পারবে না।
বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশের পদ্মার যে বিপুল আয়তন তাতে স্বাভাবিক প্রবাহ থাকলে প্রাকৃতিক ও পরিবেশগত বিপর্যয় সৃষ্টির কথা উঠতো না। কিন্তু ভারত নেপালের কোশি থেকে শুরু করে ফারাক্কা পর্যন্ত সুদীর্ঘ পথে পানি প্রত্যাহারের যে একতরফা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে- তাতে বাংলাদেশের বিপর্যয় অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠেছে। শুধু বাঁধ-ব্যারাজই নয়, গঙ্গার পানি সরিয়ে নিতে ভারত অনেক আগে থেকেই গঙ্গায় বৃহদাকার তিনটি খাল প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে। এসব খালের মোট দৈর্ঘ্য ১৩ হাজার ৬শ’ কিলোমিটার। এগুলো হচ্ছে, ‘আপারগঙ্গা ক্যানাল প্রজেক্ট’, ‘মধ্যগঙ্গা ক্যানাল প্রজেক্ট’ এবং ‘নি¤œগঙ্গা ক্যানাল প্রজেক্ট।’ এ ধরনের প্রকল্পের খালের মাধ্যমে গঙ্গার পানি সরিয়ে নিয়ে সে
চ দেবার ব্যাপক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে তারা। ‘উপর গঙ্গা খাল প্রকল্পের’ মাধ্যমে উত্তর প্রদেশের ২৫ লাখ একর জমিতে সেচ দেয়ার লক্ষ্যে ৬ হাজার কিলোমিটারের বেশী খাল কেটে পদ্মার পানি সরিয়ে নেয়া হচ্ছে। ‘মধ্যগঙ্গা ক্যানাল প্রজেক্ট’ নামের প্রকল্পে মূল ও শাখাসহ খননকৃত খালের মোট দৈর্ঘ প্রায় ১৬শ’ কিলোমিটার। ‘নিম্নগঙ্গা সেচ প্রকল্পের’ জন্য ৬ হাজার কিলোমিটার খালের মাধ্যমে গঙ্গার পানি সরিয়ে নেয়া হচ্ছে। উল্লেখ্য, গঙ্গা প্রধানত তিনটি উৎস থেকে পানিপ্রবাহ পেয়ে থাকে। এগুলো হলো, মূল উৎসের হিমবাহ থেকে উৎসারিত পানি, উপনদীগুলোর প্রবাহ এবং বৃষ্টির পানি। এছাড়াও ঝর্ণা এবং নালা-নর্দমা থেকে কিছু পানি জমা হয়। ভারত এর প্রায় সবক’টি উৎসকেই বিভিন্নভাবে বাধাগ্রস্ত করছে বলে প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়। এভাবে এসব উৎসের শতকরা ৯০ ভাগ পানি সরিয়ে নেয়া হচ্ছে। ফলে নদীতে মাত্র ১০ ভাগ পানি স্বাভাবিকভাবে প্রবাহিত হতে পারছে বলে সূত্রে প্রকাশ।
ফারাক্কা লং মার্চ ৪০তম বার্ষিকী উদযাপন কমিটি এ উপলক্ষে আজ সোমবার বিকেলে রাজশাহীর পাঠানপাড়ায় পদ্মাপাড়ের লালন শাহ মুক্তমঞ্চে গণজমায়েতের আয়োজন করেছে। গণজমায়েতে বক্তব্য দেবেন পানি ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞ ড. এসআই খান, ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী, জাবি’র সাবেক ভিসি প্রফেসর ড. জসিম উদ্দিন আহমদ, কবি ও গবেষক ফরহাদ মজহার, পানি প্রকৌশলী এম ইনামূল হক, অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ প্রমুখ। এর আগে এ উপলক্ষে পদ্মা-ফারাক্কা বিষয়ক শিশুদের চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়।
সম্পাদনা নিউজ ও যমুনা টিভি থেকে নেয়া