আমিন ইকবাল : বর্তমান পৃথিবীতে মানুষ কেন ইসলামকে নিয়ে ব্যঙ্গ করে? কেনই বা ওরা রাসুল সা. কে নিয়ে মজা করে? তাঁকে অপমান করে কার্টুন বানায়? কেন মুসলিমদের উপর এত প্রোপাগান্ডা, এত জঘন্য কথাবার্তাÑ যেগুলো সাংবাদিকতার নামে চলছে সম্পাদকীয় কলামে! এ ব্যাপারটিকে দিনকে দিন আরও আকর্ষণীয় করা হচ্ছে। আগে তারা উগ্রপন্থীদের নিয়ে কথা বলতো? তারা কথা বলতো কিছু উগ্রপন্থী আর জঙ্গি ইসলামের ভার্সন নিয়েÑ যেখানে ওরা সবাইকে খুন করতে চায়, আর নারীদের ডাস্টবিনে ফেলতে চায় ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু আস্তে আস্তে এই উগ্রপন্থীর সংজ্ঞা ঢিলা হতে হতে এমন পর্যায়ে এসেছে যে, আপনি এখন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়লেই উগ্রপন্থী। উগ্রপন্থী আগে যা উন্মাদদের বেলায় প্রযোজ্য ছিল, এখন তাদের মতেÑ কেউ একটু ইসলাম প্রকাশ করলে, সামান্য মুসলিম মুসলিম ভাব দেখালে কিংবা কোনো নারী হিজাব পরলেÑ সে নিশ্চয় উগ্রপন্থী। পুরুষদের বেলায় দাঁড়ি থাকলেই উগ্রপন্থী!
ইসলামের প্রথম যুগে রাসুল সা. ও সাহাবাদের নিয়ে ব্যঙ্গ করা হত! এখন আমাদের নিয়ে ব্যঙ্গ করা হয়! দু’টির কারণ কি এক? না, একই কারণ নয়। নবী-সাহাবাদের ব্যঙ্গ করা হতোÑ ইসলামকে বন্ধ করে দেয়ার এটি একটি উপায় ছিল। ইসলামের প্রসার ঠেকানোর উপায় ছিল। ইসলাম এতোটাই চিন্তা জাগ্রতকারী, দৃষ্টি উন্মুক্তকারী ও ন্যায়ের ডাক দিয়েছিল যে, সব ধরনের অবিচারকে প্রশ্নের সম্মুখীন করেছিল। মানুষ ইসলামের দিকে কেন্দ্রীভূত হচ্ছিল, যুবক-বৃদ্ধ সব ধরনের মানুষকে ইসলাম টেনে আনছিল, আর ওরা জানতো না কীভাবে তা বন্ধ করা যায়? তাই ওরা কৌশল অবলম্বন করলোÑ রাসুল সা. কে মিথ্যাবাদী ডাকবে। তার সাহাবাদের মিথ্যাবাদী বলবে। কিন্তু তাতে কোনো কাজ হলো না। বর্তমানে ইসলাম নিয়ে উপহাসমূলক যা হচ্ছে তার কারণ বর্তমান মুসলমানদের আচরণ। মুসলমানদের অবস্থা কী হয়ে দাঁড়ালো! আমাদের মুসলিম সমাজ কেমন দেখায়? আমাদের পাড়ার রাস্তাগুলো কেমন দেখায়? আমাদের বাসা কেমন দেখায়? আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্যের চর্চা কেমন? আমাদের সরকারগুলো কেমন? আপনি যদি দুর্নীতির উদাহরণ দেখতে চান, আপনি যদি সভ্য দুনিয়ার ঠিক উল্টোটা দেখতে চান, মুসলিম দেশগুলো ভ্রমণ করুন। বেশিরভাগই এ রকম। এমনকি মসজিদের পার্কিং এর জায়গাতেও আমাদের সভ্য হতে খুব কষ্ট! একটা সময় আমরা সুশৃঙ্খল থাকি যখন কাতার সোজা করে দাঁড়াতে হয় নামাজের সময়। এর বাইরে ভুলে যাই। নূন্যতম মানবিক শিষ্টাচারও নেই আমাদের মাঝে।
আমরা সোনালী দিনের ইতিহাস থেকে উদ্ধৃতি দিতে খুব পছন্দ করি। কিন্তু আমরা কী করেছি? আমরা কী তৈরি করেছি মানুষ হিসেবে? পৃথিবীতে কী অবদান রেখেছি? আমরা তখনই খবরের কাগজে আসি যখন বোমা মেরে কিছু উড়িয়ে দেই। অথবা কোনো ঝামেলা করি। এইসব বাইরের দৃষ্টিকোণ থেকে একটু চিন্তা করুন। আমাদের ব্যবসায়ীরা মিথ্যা বলে যখন তারা ট্যাক্স দেয়। তারা বলেন, ‘আমি কাফিরদের টাকা দিতে চাই না।’ সত্যিই তাই? আপনি কাফিরদের ট্যাক্স দিতে চান না? কিন্তু আপনি যখন মদ বিক্রি করেন তখন আপনার ইসলাম আসে না? এখন হঠাৎ করে আপনার ওয়ালা আল বারা (ধর্মীয় মূল্যবোধ) উদয় হলোÑ যখন আপনি তাদের ট্যাক্স দিতে যাচ্ছেন! আমাদের নৈতিক অবস্থা এতোটাই নিম্নমানের যেÑ অনেক ব্যবসায়ী ভাই আছেন যারা ঠিকভাবে কর্মচারীর বেতন দেয় না। এমনকি তাদের স্ত্রীদেরও মহর দেয় না। তারা পৃথিবীর অবিচার নিয়ে কথা বলছে, কিন্তু তাদের ঘরেই ন্যায়বিচার নেই। কেউ ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হবে কেন?
আমরা সেই দলের মানুষ, যাদের বিশ্বাস ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’। আমাদের পাশে আছেন আল্লাহ তায়ালা, তাঁর সাহায্য যাবতীয় সকল সমস্যার চেয়ে শক্তিশালী। কিন্তু আমরা আল্লাহর সাহায্যই চাইছি না, অন্তত সেটি অর্জন করার কোনো প্রচেষ্টা আমাদের মাঝে নেই। আল্লাহর সাহায্য বিনামূল্যে পাওয়ার মতো কোনো জিনিস নয়, এটি অ
র্জন করার জিনিস। সেজন্যে আমার ঘরের ভিতরটিকে একটি পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যেতে হবে, আমার চারপাশের মানুষগুলোকে সেই পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যেতে হবে। সবাই জানি আমরা কী ভুল করছি। তবুও আমরা ক্রমাগত সেগুলো আড়াল করে পাশ কাটিয়ে যাচ্ছি। আল্লাহ এই মানুষগুলোর অবস্থার পরিবর্তন করবেন না। এই উম্মাহর অবস্থার পরিবর্তন করবেন না। আল্লাহ বলেন, ‘আল্লাহ কোনো জাতির অবস্থার পরিবর্তন সেই পর্যন্ত করবেন না, যতক্ষণ তারা নিজেরা প্রথমে সচেষ্ট না হয়।’
ইসলামের শক্তি সেনাবাহিনীর সংখ্যায় ছিল না, তলোয়ারেও ছিল না, অস্ত্রেও ছিল না। ইসলামের সবচেয়ে শক্তিশালী দিক ছিল এর চিন্তার বহুমুখিতায় আর এটি প্রয়োগ করেই অবিচারের দিকে আঙুল প্রদর্শন করা সম্ভব হয়েছিল। প্রশ্ন করা সম্ভব হয়েছিল প্রচলিত সমসাময়িক নীতি আর দর্শনের বৈধতাকে! ইসলাম হলো সেই ধর্ম, যেই ধর্মে বলা আছে, ‘আদ’উ ইলাল্লাহি আলা বাসিরা’। আমি আল্লাহকে স্মরণ করি আমার চিন্তার জানালা খোলা রেখে, কেননা ইসলাম হচ্ছে চিন্তাশীলদের ধর্ম। কিন্তু আজ আমরা আর চিন্তাশীলদের মতো আচরণ করি না আর তাই আমাদের ইসলামেও সেই ধাঁর আর নেই। আরবের কুরাইশরা আতঙ্কে কেঁপে কেঁপে উঠেছিল আল্লাহর কিতাবের কথায়, আল্লাহর কিতাবের আয়াতই তাদের আতঙ্কের জন্যে যথেষ্ট ছিল। এটিই যথেষ্ট ছিল যে হাজার বছর ধরে চলে আসা রীতি-সংস্কৃতি ভেঙে যেতে, পরিবর্তিত হতে শুরু করবে আল্লাহর কিতাবের মাত্র কয়েকটি শব্দের প্রভাবেৃ মাত্র কয়েকটি শব্দ! কিন্তু আজ কী হয়েছে আমাদের, আমরা আর সেই শব্দগুলোর সাথে নেই।
আমি প্রার্থনা করি আল্লাহ আমাদেরকে আবার কুরআন প্রেমিক মানুষে পরিণত করুক, যেভাবে আল্লাহ চান আমরা যেন সেভাবে চিন্তা করতে পারি। আমরা আমাদের চরিত্রকে উপস্থাপন করতে পারি আমাদের ব্যক্তিগত জীবনে, আমাদের বক্তৃতা-বিবৃতিতে, ব্যবসায়ীক লেনদেনে, আমাদের সমাজে। আমরা যেন তা চিত্রিত করতে পারি যা আমাদের দ্বীনকে নিঁখুত বানিয়েছে, সুন্দর বানিয়েছে। আল্লাহ তায়ালা এই হেদায়াতের আলোকবর্তিকা আমাদের সকলের হৃদয়ে প্রজ্জ্বলিত করুক। একে শক্তিশালী রাখুক, এর শক্তি আরো বৃদ্ধি করুক। আল্লাহ তরুণ প্রজন্মকে এমন নেতৃত্ব দানের যোগ্যতা দান করুক যারা এই অন্ধকার যুগকে স্বর্ণ যুগে পরিণত করবে।
-বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবীদ নোমান আলী খানের আলোচনা থেকে (সংক্ষেপিত)