মাজাহারুল ইসলাম: প্রকল্প গৃহীত হয়। বরাদ্দ হয় মোটা অঙ্কের টাকা। কিন্তু বাস্তবায়ন হয় না সিকিভাগও। গণপূর্তের ঢাকা জোনের চিত্র এমনই। এই জোনের অধীনে থাকা রাজধানীসহ ঢাকা বিভাগের বেশ কয়েকটি সার্কেল এবং জেলা ও উপজেলা অফিসগুলোতে উন্নয়নের নামে চলছে রীতিমতো হরিলুট। জুনের মধ্যে বরাদ্দের টাকা শেষ করতে অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প গ্রহণ করে পকেট ভারী করছেন সংশ্লিষ্ট অফিসগুলোর তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী, নির্বাহী প্রকৌশলী এবং উপ-সহকারী প্রকৌশলীরা। উন্নয়নের নামে এসব এলাকায় অপচয় করা হচ্ছে সরকারের কোটি কোটি টাকা।
‘উন্নয়নের নামে অনিয়ম’ করার ঘটনায় তীব্র ক্ষোভ ও অসন্তোষ প্রকাশ করেছে জাতীয় সংসদের গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। কমিটির একাধিক সদস্য উত্থাপিত অভিযোগ সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে দায়ীদের চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির তাগিদ দিয়েছেন। তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার সংশ্লিষ্টরা। তাদের দাবি, একটি চক্র বিদ্বেষের বশবর্তী হয়ে এসব অপপ্রচার চালাচ্ছে।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, গণপূর্তের ঢাকা জোনে ২৮ ডিভিশনের অধীনে বিভিন্ন সংস্কার কাজের জন্য গত অর্থবছরের এককালীন ৩০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়। এছাড়া আরও কয়েকশ’ কোটি টাকার থোক ও উন্নয়ন বরাদ্দ রয়েছে। অভিযোগ উঠেছে, এসব টাকার সিংহভাগই অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে নিজেদের পকেটস্থ করেছেন দায়িত্বশীলরা। অধিকাংশ ক্ষেত্রে কাঁচাপাকা ইস্টেমেটের মাধ্যমে অর্থ লোপাট করা হয়েছে। এছাড়া অপ্রয়োজনীয় কাজ করা এবং অনেক ক্ষেত্রে কাজ না করেই ভূয়া বিল ভাউচার তৈরি করে হাতিয়ে নেয়া হয়েছে বিপুল পরিমাণ টাকা।
আর এসবের মদতদাতা হিসেবে অভিযোগের আঙ্গুল উঠেছে ঢাকা জোনের ২৮টি ডিভিশনের টেন্ডার মূল্যায়ন কমিটির সভাপতি হিসেবে জোনটির দায়িত্বে থাকা গনপূর্ত অধিদপ্তরের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী রফিকুল ইসলামের বিরুদ্ধে। সবকিছু জেনেই বিশেষ সুবিধা নিয়ে তিনি ভূয়া প্রকল্পে অনুমোদন দিয়েছেন। তার ব্যাক্তিগত সহকারী ফখরুল ইসলাম বাবু এবং গণপূর্ত ডিপ্লোমা প্রকৌশলী সমিতির সাধারন সম্পাদক আলী আকবরসহ আস্থাভাজন বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা লোপাটকৃত এসব অর্থের বিশাল একটি অংশ সংশ্লিষ্টদের নিকট থেকে নিয়ে তার একাউন্টে জমা করে দিচ্ছেন।
তিনি প্রতিটি ইস্টিমেটে ৫ শতাংশ হারে ঘুষ নিচ্ছেন দাবি করে অভিযোগে বলা হয়, ঢাকা জোনের অধীনে ঢাকার ৫টি সার্কেলের ২২টি ও ময়মনসিংহ সার্কেলের ৬টিসহ মোট ২৮টি ডিভিশনের আওতায় ৫ লাখ টাকার অধিক মূল্যের মেরামত রক্ষণাবেক্ষণ কাজের যেকোনো ইস্টিমেট অনুমোদন করাতে তাকে ৫ শতাংশ হারে অগ্রীম দিয়ে দিতে হয়। তা না হলে ইস্টিমেট অনুমোদন হয় না। প্রতিটি প্রকল্পের সাইট পরিদর্শনে গিয়ে বিভিন্ন অজুহাতে তিনি কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন। গত বছরে উত্তরা অ্যাপার্টমেন্ট প্রকল্পে নতুন করে কার্যাদেশ দেয়ার ক্ষেত্রে এই প্রকৌশলী ৬ শতাংশ হারে কমিশন নিয়েছেন। এসব কারণে কয়েকজন স্বনাম ধন্য ঠিকাদারদের সঙ্গে দ্বন্ধেও জড়িয়ে পড়েন তিনি।
এদিকে ঢাকা জোনের বিভিন্ন প্রকল্প বা¯বায়নের নামে বিএনপি-জামায়াত সমর্থকদের অর্থনৈতিকভাবে প্রতিষ্ঠিত করা হচ্ছে বলেও অভিযোগ উঠেছে। জোন প্রধান নীতিগতভাবে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির বিরোধীতাকারী হিসেবেই চিহ্নিত বলে দাবি করে অভিযোগে বলা হয়েছে, ২০০৯ সালে মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর দলীয় উদ্যোগে গনপূর্ত অধিদপ্তরে বিএনপি-জামায়াত সমর্থক প্রকৌশলীদের যে গোপন তালিকা তৈরী করা হয়েছিল তাতে জামায়াত নেতা গোলাম আযমের নিকটাত্মীয় হিসেবে প্রথম ক্রমিকেই ছিল রফিকুল ইসলামের নাম। তিনি কাজের টেন্ডার মূল্যায়ন কমিটির সভাপতি হিসেবে জামায়াত-বিএনপি সমর্থিত ঠিকাদারদের কৌশলে কাজ পাই
য়ে দেয়ার সুপারিশ করে কাজ পাইয়ে দেন। এই কাজে তাকে সহযোগিতা করতেই সাবেক পূর্তমন্ত্রী মির্জা আব্বাসের ব্যাক্তিগত সহকারী ফখরুল ইসলাম বাবুকে নিজের পিএ হিসেবে নিয়োগ দিয়ে রেখেছেন।
গনপূর্তের এসব অনিয়ম ও দুর্নীতির বিষয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্যরা। বেশ কয়েকজন প্রভাবশালী সদস্য বলেন, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি যখন রাষ্ট্রক্ষমতায় তখন স্বাধীনতা বিরোধী সমর্থকদের পুর্ণবাসনের চেষ্টা শুধু অপরাধই নয়, গর্হিত অপরাধ। যদি এমনটাই ঘটে থাকে তবে যারা এ কাজে জড়িত তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি পেতে হবে।
এবিষয়ে গণপূর্তের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী রফিকুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি এসব অভিযোগ অস্বীকার করেন। ঢাকা জোনে কোনো অনিয়ম হয় না দাবি করে তিনি মানবকণ্ঠকে বলেন, এই জোনের সব কাজ নির্দিষ্ট আইন মেনেই করা হচ্ছে। আর জামায়াত-বিএনপির সমর্থকদের পুর্ণবাসনের প্রশ্নই আসে না। নিজের পরিবার ও আত্মীয় স্বজন আওয়ামী লীগের সমর্থক দাবি করে একটি চক্র তার বিরুদ্ধে এসব অপপ্রচার চালাচ্ছে বলে জানান এই প্রকৌশলী।