সিলেটের সকাল : দেশের সবচেয়ে বড় গ্যাসক্ষেত্র বিবিয়ানায় কম্প্রেসার বসানোর পরিকল্পনা করেছে শেভরন। এর মাধ্যমে তারা গ্যাসক্ষেত্রটির উত্পাদন বৃদ্ধির চেষ্টা করছে। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখনই কম্প্রেসার বসিয়ে গ্যাস তোলা হলে গ্যাসক্ষেত্রটি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। দ্রুত এর উত্তোলনযোগ্য মজুদ ফুরিয়ে যেতে পারে। এর আগে দেশের সমুদ্রবক্ষে আবিষ্কৃত একমাত্র গ্যাসক্ষেত্র সাঙ্গুর মজুদও অতিরিক্ত গ্যাস উত্তোলনের কারণে নির্ধারিত সময়ের আগেই শেষ হয়ে গিয়েছিল।
চলতি মে মাসের প্রথম সপ্তাহে পেট্রোবাংলা ও শেভরনের কর্মকর্তাদের মধ্যে একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ওই বৈঠকে হবিগঞ্জের বিবিয়ানা গ্যাসক্ষেত্রে কম্প্রেসার বসানোর বিষয়ে দ্রুত অনুমতি দিতে অনুরোধ জানায় যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানি শেভরন। একই সঙ্গে তারা প্রতি বছর তিন ভাগ হারে গ্যাসের দাম বৃদ্ধিরও প্রস্তাব দেয়। সভায় উপস্থিত জ্বালানি বিভাগ ও পেট্রোবাংলার একাধিক কর্মকর্তা জানান, বহুজাতিক কোম্পানিগুলো গ্যাস উত্তোলনে প্রাথমিক বিনিয়োগ উসুল (কস্ট রিকভারি) করার পর নতুন করে বিনিয়োগের চেষ্টা করে। শেভরনও একই কাজ করতে চাচ্ছে। কস্ট রিকভারির পর বাংলাদেশ ৮০ ভাগ গ্যাস পাবে। আর বহুজাতিক কোম্পানি পাবে ২০ ভাগ। নতুন বিনিয়োগ হলে বাংলাদেশের অংশীদারিত্ব কমবে। এতে দেশ আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
বিশেষজ্ঞরা জানান, গ্যাসকূপ থেকে সক্ষমতার অতিরিক্ত গ্যাস উত্তোলন করা হলে ভূ-অভ্যন্তরের গ্যাসস্তর ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। এতে গ্যাসের স্বাভাবিক প্রবাহ কমে গিয়ে গ্যাসক্ষেত্রের জীবনকাল সীমিত হয়ে যায়। অর্থাত্ নির্ধারিত সময়ের আগেই ক্ষেত্রটি পরিত্যক্ত ঘোষণা করতে হয়। এর আগে সাঙ্গুর ক্ষেত্রে এই ঘটনা ঘটেছে।
এ বিষয়ে পেট্রোবাংলার সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক হোসেন মনসুর বলেন, বিবিয়ানায় এখনই কমেপ্রসার স্থাপনের প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। গ্যাসের চাপ কমে গেলে তার ব্যাখ্যা দেয়া উচিত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. বদরুল ইমাম বলেন, অতিরিক্ত গ্যাস উত্পাদনে গ্যাসক্ষেত্রে বিপর্যয় ঘটে। বিবিয়ানায় মাত্রাতিরিক্ত উত্পাদন কমিয়ে অন্য ক্ষেত্রগুলোর উন্নয়ন করা এবং নতুন গ্যাস অনুসন্ধান জোরদার করা প্রয়োজন।
জানা যায়, বিবিয়ানা গ্যাসক্ষেত্রটি থেকে প্রতিদিন ১ হাজার ২০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উত্তোলন ক্ষমতার স্থলে গত ১ মে থেকে ৮৫৯ দশমিক ৫ মিলিয়ন ঘনফুট উত্তোলন করছে শেভরন। গ্যাসের চাপ কমে গেছে বলে দাবি করা হচ্ছে। এর ফলে ২০১৮ বা ২০১৯ সালের পর বিবিয়ানাতে গ্যাস উত্পাদন আস্তে-আস্তে কমতে থাকবে। বর্তমান ধারায় গ্যাস উত্পাদন হলে ২০৩০ থেকে ২০৩৫ সাল নাগাদ এর উত্তোলনযোগ্য গ্যাস শেষ হয়ে যাবে।
পেট্রোবাংলার এক কর্মকর্তা জানান, শেভরনের কর্মকর্তারা দাবি করছেন, বিবিয়ানায় মজুদ গ্যাসের ৭০ ভাগ তাদের আগের বিনিয়োগের মাধ্যমে তোলা সম্ভব। এ বিষয়ে তারা একটি সম্ভাব্যতা জরিপ চালিয়েছে। ওই সম্ভাব্যতা জরিপের জন্য ৫০ কোটি ৩০ লাখ টাকা খরচ হয়েছে। জরিপের ফলাফল অনুযায়ী, একটি কমেপ্রসার স্থাপন করলে অতিরিক্ত এক ট্রিলিয়ন ঘনফুট (টিসিএফ) গ্যাস তোলা সম্ভব। এজন্য নতুন করে ৪৬৯ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করতে হবে। ওই কর্মকর্তা বলেন, গ্যাসের চাপ (প্রেসার) কমে গেলে নতুন বিনিয়োগ করার দরকার নেই। গ্যাসক্ষেত্রের আশপাশে এই গ্যাস সরবরাহ করতে পারি। এক্ষেত্রে নতুন করে বিপুল বিনিয়োগের দরকার হয় না। আর কম্প্রেসার বসিয়ে গ্যাস উত্তোলন করলে ২০৩০ সালের অনেক আগেই গ্যাসক্ষেত্রটির মজুদ শেষ হয়ে যেতে পারে।
পেট্রোবাংলা সূত্র জানায়, বিবিয়ানাতে বিভিন্ন কূপে গ্যাসের চাপ কমতে শুরু করেছে। যে সব কূপে আগে ১ হাজার ৮০০ পিএসআই চাপে গ্যাস তোলা হতো এখন তা কমে ১ হাজার ৫০০ পিএসআই হয়েছে। আর ১ হাজার ৫০০ পিএসআই চাপে গ্যাস তোলা কূপের চাপ অন্তত ৩০০ পিএসআই কমেছে। তবে দুটি কূপ থেকে ২ হাজার ৩০০ পিএসআইয়ে গ্যাস তোলা হচ্ছে। এক হাজার পিএসআইয়ের নিচে চাপ নেমে যাওয়াকে ক্ষতিকর বিবেচনা করা হয়।
উল্লেখ্য, ১৯৯৮ সালে সিলেটের হবিগঞ্জ জেলায় ১২ নম্বর ব্লকে দেশের অন্যতম বৃহত্ এই গ্যাসক্ষেত্রটি আবিষ্কার করে আরেক মার্কিন কোম্পানি ইউনিকল। পরে তারা বাংলাদেশে তাদের সম্পদ শেভরনের কাছে বিক্রি ও হস্তান্তর করে।
এ প্রসঙ্গে বিদ্যুত্, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু বলেন, কম্প্রেসার বিষয়ে শেভরনের প্রস্তাবের বিপরীতে আমরা তাদের কাছে কিছু তথ্য জানতে চেয়েছি। ওই প্রশ্নগুলোর উত্তর পাওয়া গেলে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে।